প্রাককথন ঃ
১৮৫০- ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে সংঘঠিত তাইপিং বিদ্রোহ চীনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সংযোজন করে। কারণ এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, আদর্শ, লক্ষ্য ও ব্যপকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এ বিদ্রোহ চীনের অভ্যান্তরীণ ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছিল। মূলত তাইপিং বিদ্রোহ ছিল উনিশ শতকের প্রথম গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী চীনা বিদ্রোহগুলোর পথ প্রদর্শক। তাইপিং বিদ্রোহ একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। এই আন্দোলন কোন আকস্মিক একটি ঘটনা ছিল না। বরং এ বিদ্রোহ ছিল যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কার্ল মার্কস তার “Revolution in China and Europe” প্রবন্ধে তাইপিং বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছেন,
“The occasion of this outbreak has unquestionably been offered by English canon forcing upon China that soporific drug called opium.” নিম্নে তাইপিং আন্দোলনের কারণ, প্রকৃতি ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
কি কারণে তাইপিং বিদ্রোহ হয় :
তাইপিং শব্দের অর্থ ‘মহান শান্তি’ কিন্তু মাঞ্চুদের ২৫০ বছরের কিঞ্চিদধিক স্থায়ী রাজত্বকালে এই আন্দোলন অপেক্ষা অধিকতর শান্তি ভঙ্গকারী আভ্যন্তরীণ বিপর্যয় আর ঘটেনি। এ ছাড়া উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বহিরাক্রমন এবং আভ্যন্তরীণ বিস্ফোড়ন চীন দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বরতার ইঙ্গিত বহন করে। তখন চিং শাসকেরা যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং বলিষ্ট হস্তে দেশের প্রশাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হতেন তাহলে চীন এক ভয়াবহ সংকটের কবলে পড়ত না। কিন্তু তৎকালীন চিং সরকারের দুর্বলতা দেশে সংকট আমন্ত্রন করে। দেশ তখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। এই বহুবিদধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে চিং সরকার অপারগ হন। যার অনিবার্য্য পরিনতি হিসেবে তাইপিং বিদ্রোহ রূপধারণ করে। নিম্নে তাইপিং বিদ্রোহের কারণ আলোচনা করা হলো।
(১) প্রথম ঈঙ্গ-চীন যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি :
প্রথম ঈঙ্গ-চীন যুদ্ধে চীনের পরাজয় ও নানকিং এর অপমানজনক সন্ধি হতে চীনা জনসাধারণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে। এই পরাজয় ও অপমানজনক সন্ধির জন্য তারা মাঞ্চু সরকারকে দায়ি করে। তাই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মাঞ্চু সরকারকে পদচ্যুত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। যা বিপ্লবকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
(২) মাঞ্চু শাসকদের দুর্বলতাঃ
ঐতিহ্যগতভাবে বহিরাগত হিসাবে মাঞ্চু শাসকদের প্রতি জনসাধারণের ঘৃণা ছিল। যেহেতু প্রথমদিকের মাঞ্চু শাসকরা দক্ষ ও শক্তিশালী ছিল তাদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদ জোরদার হতে পারেনি। পরবর্তী মাঞ্চু শাসকগণ যেমন- Too Kung , সেন কোং যথাক্রমে ১৮২০, ১৮৬০ এর দিকে দুর্বল ও অদক্ষ শাসক হিসেবে প্রমাণিত হয়। ফলে চীনে সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। তা ক্ষুব্ধ জনগণকে তাইপিং বিদ্রোহের ইন্ধন যোগায়।
(৩) সমাজের দরিদ্র্য শ্রেণীর উপর নিপীড়ণঃ
মাঞ্চু শাসনকালে চীনা সমাজে কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, মিস্ত্রিসহ দরিদ্র্য সাধারণ জনগোষ্ঠী ছিল নিপীড়িত ও নির্যাতিত। সমাজের সকল স্তরের জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত এ দরিদ্র শ্রণীকে এমনভাবে আন্দোলিত করেছিল যা বিদ্রোহ আকারে আত্ম প্রকাশ করে। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল, পুরাতন শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা
(৪) সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাঃ
তাইপিং আন্দোলনের পশ্চাতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যহীনতা যথেষ্ট পরিমাণে দায়ি ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ক. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও চাষযোগ্য জমির সংকোচন ঃ
মাঞ্চু শাসনকালে ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও আবাদী জমির পরিমান আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়নি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায় ১৭৪০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পায় ২০০%। অন্যদিকে ১৬৬১ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত আবাদী জমির পরিমান বৃদ্ধি পায় ৩৫%। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাদী জমির অসম বৃদ্ধি হেতু মাথাপিছু আবাদী জমির পরিমান হ্রাস পায়। এ ছাড়া ৬০ শতাংশ লোক বেকার ও ভূমিহীন হয়ে পড়ে। কৃষকরা এ অবস্থায় অন্ন সংস্থানের জন্য কুসিদদের নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয় এবং পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেকে দুবৃত্তের জীবন বেছে নেয়। এভাবে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী চরম অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। এরুপ সর্বহারা দল স্বাভাবিক কারণে বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
খ. মুদ্রার মূল্যমান হ্রাসঃ
নানকিং চুক্তির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা নিষিদ্ধ না হওয়াতে যে বেআইনী আফিম ব্যবসা অবাধে চলতে থাকে ফলে ব্যাপক হারে রৌপ্য মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যেতে থাকে। এর ফলে রৌপ্য মুদ্রার সংকটের সাথে সাথে তাম্র মুদ্রার মূল্যমান হ্রাস পায়। ফলে জনসাধাণের অসন্তোষ বিপ্লবের পথ প্রসস্থ করে।
গ. অবাধ বিদেশী পণ্যের আমদানীঃ
নানকিং চুক্তির মাধ্যমে বন্দরকে উম্মুক্ত করার কারণে বিদেশী পণ্য চীনে স্রোতের মতো প্রবেশ করতে থাকে। যেমন ১৮৪২ সালে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য ৯,৬৯,৩৮১ পাউন্ড হলেও ১৮৪৫ সালে তা দাড়ায় ২৩,৯৪,৮২৭ পাউন্ড। এভাবে বিদেশী পণ্যের আমদানীর ফলে চীনের স্থানীয় শিল্পের বিনাশ ঘটে। ফলে অনেক শিল্প শ্রমিক কর্মচ্যুত হয় এবং তারা তাইপিং আন্দোলনে যোগ দেয়।
(৫) আফিম ব্যবসার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া-জনগণের অর্থনৈতিক ক্লেশ ঃ
নানকিং এর সন্ধি আফিম এর ব্যবসা নিষিদ্ধ করেনি। ফলে পরবর্তী বছরগুলোতে আফিম এর ব্যবসা অধিকতর প্রসার লাভ করে। তখন তাম্রমুদ্রার মাধ্যমে বাজারে চাল ক্রয় করতে হত এবং বেতন দেয়া হত। তাম্রমুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। এবং জনগণকে অধিক মূল্যে দ্রব্যাদি ক্রয় করতে হয়। এতে করে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ পুঞ্জিভূত হতে থাকে।
(৬) প্রশাসনিক দূর্ণীতিঃ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় মাঞ্চু প্রশাসনেও দূর্ণীতি একটা প্রকট আকার ধারণ করে। এসময় অনেক রাজকর্মচারী প্রশাসনিক কাজকর্ম থেকে সাহিত্য আলোচনা, বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলন ও জনহিতকর কাজে বেশি মনোনিবেশ করে। এ সময় অর্থের বিনিময়ে সরকারের বিভিন্ন পদ বিক্রি হতে থাকে। ফলে ক্রয়কৃত পদসমূহের অধিকারীরা চাকুরীতে প্রবেশ করেই অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য দূর্ণীতির আশ্রয় নেয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এরুপ দূর্ণীতি ও বিশৃংখলা বিপ্লবের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে।
(৭) সামরিক উৎকর্ষতা হ্রাসঃ
সামরিক বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ও দক্ষতার অভাব দেখা দেয়। ‘ঊরমযঃ ‘Eight Banners’ ’ সেনাবাহিনী এবং ‘Green standard সেনাবাহিনী (খঁ-ণরহম) পূর্বের মত শৌর্য বীর্যের পরিচয় দেয় না। পরিচয় দেয় না অস্ত্র প্রয়োগের দক্ষতারও আফিমের যুদ্ধে চীনের পরাজয় চীনা সেনাবাহিনীর অক্ষতা ও অ যোগ্যতাই প্রমাণিত করে।
(৮) প্রাকৃতিক বিপর্যয়ঃ
১৮৪০-১৮৫০ এর দশকে চীনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়ে। যেমন- ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হোনানে ভয়ংকর অনাবৃষ্টি জনিত রুক্ষতা, ইংৎসি নদীর বন্যায় (অহযবরি), (করধহমংঁ) এবং (ঈযবশরধহম) প্রদেশ সমূহে প্লাবন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ইয়োলো নদীর গতি পথ দক্ষিণ থেকে উত্তরে সান্টু এর দিকে পরিবর্তনের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলে প্লাবিত হয়। ফলে চীনাবাসী দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়্।ে যখন সরকারী সাহায্য ছিল আন্তরিকতা শূণ্য।
(৯) দক্ষিণ চীনে অসন্তোষঃ
আফিম যুদ্ধর পরে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টনের পরিবর্তে মধ্য চীনের সাংহাই বিদেশী বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে হাজার হাজার লোক বিশেষকরে কুলি ও দিনমজুর শ্রেণী বেকার হয়ে পড়ে। এতে ক্যান্টনবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে তাইপিং বিদ্রোহে অংশ নেয়।
(১০) স্থানীয়দের সাথে হাক্কাদের সংঘর্ষঃ
উত্তর চীন থেকে দক্ষিণ চীনে আগত কৃষকদের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হাক্কা শ্রেণী কুয়াংটু ও কুয়াংসি প্রদেশে বিচরণ করে। সেখানে স্থানীয়দের সাথে হাক্কাদের সংঘর্ষ বাধে। ফলে দক্ষিণ চীনের পরিবেশ আরো অশান্ত হয়ে বিপ্লবের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করে।
(১১) দক্ষিণ চীনে মাঞ্চু শাসনের দুর্বলতাঃ
আমরা জানি, তাইপিং বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে দক্ষিণ চীনে। সেখানে মাঞ্চু শাসকদের ভিত্তি ছিল দুর্বল। তাছাড়া ইয়াংসির দক্ষিণে ইউরোপীয়দের বসবাসের ফলে সেখানে পশ্চিমা প্রভাব পড়েছিল। এক দিকে মাঞ্চু শাসনের দুর্বলতা অন্যদিকে পশ্চিমা প্রভাব তাইপিং বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তোলে। জ্যা শ্যনে বলেন, “South China was the cradle of the Taiping rebellion”
(১২) জলদস্যুবৃত্তি দমন ঃ
১৮৪২ সালে বৃটিশ নৌবাহিনী জলদস্যুদের করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আনেক জলদস্যু চীনের অভ্যান্তরে পলায়ন করে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, অপরাধ জগতের সাথে য্ক্তু ঐইসব ব্যক্তিরা পরবর্তীকালে গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেয় এবং তাইপিং বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(১৩) ধর্ম জগতে সংকট ঃ
তাইপিং বিদ্রোহের প্রাক্কালে বৌদ্ধ ধর্ম, তাও ধর্ম বা কনফুসীয় ধর্ম, কোনটিই চীনাদের আস্থাভাজন ছিলনা। বৌদ্ধ ধর্মের সংসার বৈরাগ্য, তাও ধর্মের নানা কুসংস্কার, কনফুসীয়দের প্রাচীন বিদ্যায় পাণ্ডিত্যাতিমান এই তিন ভিন্ন প্রকৃতির ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য চীনাদের দিশেহারা করে তোলে। বৌদ্ধ ধর্মে অষ্টমার্গ প্রভৃতি বিলুপ্ত হয়ে আসে, বাকী থাকে শুধুমাত্র “অমিতাভ নাম” জপ। নাম জপে মুক্তি। কনফুসীয় নীতি ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মাঞ্চু রাজবংশ। এ সময় বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে ইউরোপীয়দের সংস্পর্শ এবং সেই সঙ্গে খৃষ্ট ধর্মের প্রচার দেশের ধর্মীয় অবস্থাকে অধিকতর জটিল করে তোলে।
(১৪) হংশিউ চুয়ানের নেতৃত্বে ঃ
উপরোক্ত কারণগুলো যখন জনগণকে প্রবল ভাবে মাঞ্চু বিরোধী করে তুলেছিল এখনব দক্ষিণ চীনের কোয়াংটাং প্রদেশের অধিবাসী ইংহুংশিউ চুয়ান মাঞ্চু শাসকদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে প্রচারনা শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন যে, স্বপ্নে দিব্য দর্শনের মাধ্যমে তিনি নতুন ধর্ম ও নতুন রাষ্ট্র গঠনের নির্দেশ পেয়েছেন। নির্দেশিত ধর্মকে তিনি তাইপিং ধর্ম এবং নির্দেশিত রাষ্ট্রকে Taiping tien Kuo বা সহায় শান্তির স্বর্গীয় রাজ্য নামকরণ করেন। এবং নিজেকে স্বর্গীয় রাজ্য বলে ঘোষণা করেন। তার প্রচারনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হাজার হাজার নিঃস্ব, দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ তার দলে যোগদান করে। ফলে শিঘ্রই ক্ষুব্ধ জনগণ মাঞ্চুবিরোধী তাইপিং আন্দোলনে যোগদান করে বিপ্লবকে অত্যাসন্ন করে।
তাইপিং বিপ্লবের প্রকৃতি ঃ
সমাজবিজ্ঞানী মনবেন্দ্রনাথ রায় তার বিখ্যাত “জবাড়ষঁঃরড়হ ধহফ পড়ঁহঃবৎ জবাড়ষঁঃরড়হ রহ ঈযরহধ” গ্রন্থে তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন, “Revolution and counter Revolution in China” MÖ‡š’ ZvBwcs we‡`ªv‡ni cÖK…wZ m¤ú‡K© e‡j‡Qb, “The much maligned, misinterpreted and little understood Taiping Revolution represented the entrance of China into the period of bourgeois-democratic Revolution”. নিম্নে এ আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. ধর্মীয় আন্দোলন: গোড়ার দিকে তাইপিং আন্দোলন ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন। বৌদ্ধ, তাও এবং কনফুসীয় দর্ম বিরোধী। এই আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল খৃষ্টধর্ম প্রচারের মাধ্যমে সমগ্র জনসংখ্যাকে চীনারূপী খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা এবং একনায়কত্বের অধীনে দেশে একটি ধর্ম রাজ্য স্থাপন করা। আন্দোলন ক্রমশ রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। তখন ইহার উদ্দেশ্য হয় মাঞ্চু রাজত্বের উচ্ছেদ সাধন করে সমগ্র চীনে স্বর্গীয় রাজার প্রভৃত্ব স্থাপন করা। এ উদ্দেশ্যে তাইপিং বা পৌত্তলিকতার বিরোধীতা করে। বহু বৌদ্ধ মন্দির ও বেদ্ধৈ মূর্তি ধ্বংস স্তুপে পরিণত করে। সুতরাং তাইপিং বিদ্রোহ প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় আন্দোলন ছিল একথা বলা যায়।
২. মাঞ্চু বিরোধী আন্দোলন: মাঞ্চু শাসকগণ চীনে কখনই জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। তাদের উচ্ছেদ সাধনই ছিল তাইপিং বিদ্রোহের উদ্দেশ্য। শুরুর দিকে এ আন্দোলন বিদেশীদের আন্তরিকতা লাভ করে। কারণ তাইপিং বা পশ্চিমা বণিকদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে আগ্রহী ছিল। তাইপিংদের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমারা যাতে কোন ক্রমেই মাঞ্চু সরকারকে সাহায্য না করে। সুতরাং প্রকৃতির দিক থেকে এটা মাঞ্চু বিরোধী আন্দোলন ছিল।
৩. কৃষক বিদ্রোহ বা কৃষক আন্দোলন: চীনা সাম্যবাদী ঐতিহাসিকগণ তাইপিং বিদ্রোহকে আধুনিক চীনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কৃষক পরিবারে হওয়ায় তাদের নেতেৃত্বে সংগঠিত আন্দোলনে কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ। এ জন্য অনেকেই এ আন্দোলনে কৃষকরা ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। এছাড়া কৃষকদের আর্থিক ও সামাজিক দূর্গতি এ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ। এজন্য অনেকেই এ আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের পর্যায়ে করার চেষ্টা করেছেন।
৪. জাতীয় আন্দোলন: কেউ কেউ তাইপিং বিদ্রোহকে সর্বাত্মক জাতীয় আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। কারণ যে দেশের অধিকাংশ জনগণ কৃষক সে দেশের কৃষক বিদ্রোহ আপামর জনগণের বিদ্রোহের নামান্তর। তাছাড়া মাঞ্চু শাসনের অবসানের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিই ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। এদিক থেকে এ আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলন বলা যেতে পারে।
৫. গণতান্ত্রিক আন্দোলন: কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিকের মতে, তাইপিং বিদ্রোহ গণতান্ত্রিক ও প্রগতি বাদী আন্দোলন। এটা ছিল বিপ্লবাত্মক কর্মকান্ডের সূচনা পর্ব যা বিশ শতকে চীনা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পথ উম্মুক্ত করে। তাই চীনের পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাগণ যেমন সান ইয়াৎ সেন, কাং ইউ ্ওয়েই, লিয়াং-চি-চাও প্রমুখ এ বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ এ টিকে চীনের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করেছেন।
তাইপিং বিপ্লবের ফলাফল ঃ
১. চীনাদের প্রশাসনিক পদলাভ: তাইপিং আন্দোলন শেষে মাঞ্চু সরকার কার্যত গদিচ্যুত না
২. প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ শুরু: তাইপিং বিপ্লবের অভিজ্ঞতা মাঞ্চু শাসকদেরকে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণে উৎসাহিত করে। পূর্বে প্রাদেশিক শাসকগণ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতো না। প্রদেশের পক্ষ থেকে মাঞ্চু সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। কিন্তু পরবর্তী কালে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ ক্রমশ কেন্দ্রের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং প্রদেশের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কোন জাতীয় সমস্যা সমাধানে মাঞ্চু সরকার প্রাদেশিক কর্মচারীদের উপেক্ষা না করে তাদের সাথে পরামর্শ করা যুক্তিসংগত মনে করে।
৩. বেসরকারী সেনাবাহিনীর অগ্রদূত: বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত হিউনান যুগে বেসরকারী সেনাবাহিনীর অগ্রগামী হিসাবে গণ্য হয়।
৪. বিপ্লবের পরিবেশ বজায় রাখা: আন্দোলন দমনের পর অবশিষ্ট তাইপিংগণ আত্মগোপন করে এবং Heverand Earth Society তে যোগদান করে বিপ্লবের পরিবেশ সঞ্জীবিত করে রাখে।
৫. পরবর্তী বিপ্লবীদের উপর প্রভাব সৃষ্টি: তাইপিং বিপ্লব পরবর্তী বিপ্লবীদের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমন-
ক. চীনা প্রজাতন্ত্রের জনক সান ইয়াৎ সেন তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার জন্য তাইপিংদের নিকট বহুলাংশে ঋণী। তাইপিং আন্দোলনের পরিসমাপ্তির দুউ বৎসর পর সান ইয়াৎ সেনের জন্ম । শৈশবে তাইপিংদের গল্প শুনে তিনি এতই প্রভাবান্বিত হন যে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে তিনি দ্বিতীয় হুং নামে পরিচিত হতে ইচ্ছুক হন। তাইপিং বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করে। তার তৃতীয় নীতি সাম্যবাদ তাইপিংদের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কিত নীতি দ্বারা প্রভান্বিত হয়।
খ. তাইপিং বিদ্রোহে কৃষকদের অংশগ্রহণ কার্লমার্কসকে আশান্বিত করে। এই চিন্তায় যে কৃষক সম্প্রদায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
গ. সাম্যবাদী নেতৃবৃন্দ আদার্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রহণযোগ্য যা কিছু তা গ্রহণ করেন এবং সাম্যবাদী আন্দোলন জোরদার করেন।
ঘ. তাইপিং আন্দোলন একদিকে যেমন সাম্যবাদী চীনের উত্থানের পশ্চাতে আদর্শগত প্রেরণা যোগায়। তেমনি অন্যদিকে ১৯১১ সালের প্রজাতন্ত্র আন্দোলনের পথও প্রস্তুত করে।
কি কারণে তাইপিং বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় ঃ
১. নৈতিক অবক্ষয়: তাইপিং নেতৃবৃন্দের ক্রমশ নৈতিক অবক্ষয় তাইপিং আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। নানকিং দখলের স্বল্পকালের মধ্যেই স্বর্গীয় এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সর্বপ্রকার তাইপিং আদর্শ ত্যাগ করে আপত্তিজনক সাধারণ তাইপিংদের মদ্যেও সংক্রামিত হয়ে তাদেরকে মতিভ্রষ্ট করে।
২. ক্ষমতার দ্বন্দ্বঃ তাইপিংদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন দলের সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আন্দোলনকে ব্যর্থতায় পর্যবশিত করে।
৩. সরকারী সেনাবাহিনীর পূর্ণগঠনঃ একদিকে যেমন তাইপিংগণ শক্তি হারিয়ে দূর্বল হতে থাকে তেমনি অপর দিকে সরকারী পক্ষ শক্তি সঞ্চয়ে উদ্যোগী হয়। সেং কুয়ো ফান প্রমুখ সরকার পক্ষীয় নেতৃবর্গ স্থানীয় স্বদেশ রক্ষী সেনাদলগুলি উচ্চতর সামরিক শিক্ষাদান করেন এবং অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত করে সুগঠিত সেনাবাহিনীতে পরিণত করেন। ঐতিহাসিক ঔধপশ এৎধু তার সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত “Rebellions and Revolution : China from 1800s to the 1980s” গ্রন্থে বলেছেন, “If Hong Xiuquan inspired mao Tse- Tung, Zeng, Quofan equally inspired Chiang Kaishek”
৫. অন্যান্য বিদ্রোহী দলের সাথে যোগাযোগের অভাবঃ তাইপিং আন্দোলনের সাথে অন্যান্য সমসাময়িক মাঞ্চু বিরোধী আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ ছিলনা। বিদ্রোহাত্মক ট্রায়াড সোসাইটি ১৮৫৩-৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সাংহাই অধিকার করে, সরকারবিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা না থাকায় সরকারের তাইপিং আন্দোলন দমনে সুবিধা হয়।
৬. আদর্শগত বিরোধঃ তাইপিং আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মভিত্তিক। কিন্তু তাইপিংদের আদর্শ হয় দেব মূর্তি ও দেব মন্দির ধ্বংস করা। এতে বিদ্বুৎ সমাজ ও কৃষক সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ হয়। ইম্যানুয়েল সু বলেছেন, Jack Gray Zvi mv¤cÖwZK Kv‡j cÖKvwkZ “Rebellions and Revolution : China from 1800s to the 1980s” MÖ‡š’ e‡j‡Qb,“Indeed their religious ideology alienated both Chinese and Westerner alike”
৮. রাজাদের মধ্যে দলদলিঃ হুং এর অধীন পাঁচজন রাজা উপাধীধারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিদ্বেষ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আন্দোলনকে দূর্বল করে তোলে।
৯. পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের বিরোধীতাঃ তাইপিং সরকার ছিল আফিম ব্যবসার বিরোধী। ফলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাইপিংদের দমনে মাঞ্চু সরকারকে সাহায্য করতে থাকে।
১০. ক্যাপ্টেন গর্ডনের সামরিক তৎপরতা ঃ ১৮৬৪ সালে ক্যাপ্টেন গর্ডনের সামরিক তৎপরতায় তাইপিং বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৪ বছর ব্যাপী বিদ্রোহকালে তাইপিংগণ ১৬টি প্রদেশ অধিকার করে এবং ৬০০ টি শহর ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। কিন্তু শেষ অবধি তাইপিং বিপ্লব ব্যর্থ হয়।
তাইপিংদের বিধি-বিধানসমূহঃ
তাইপিংদের বিধি-বিধানসমূহ নিম্নে প্রদত্ত্ব হলো।
(১) কু-অভ্যাস বর্জন ও জীবনে সংযমের অনুশীলন।
(২) ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পত্তি সঞ্চয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা, ভূমি-ব্যবস্থার সংস্কার।
(৩) সামরিক ও বেসামারিক প্রশাসনে ঐক্যসাধন।
(৪) সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে ঐক্যসাধন।
(৫) নূতন পঞ্জিকা প্রবর্তন।
(৬) তাইপিং রাজ্যে নারীদের স্থান।
(৭) দেবদেবীর মূর্তি চূর্নীকরণ।
(৮) রোমান ক্যাথলিক বিরোধী এবং বিদেশী বিরোধী।
(৯) সাহিত্যের সংস্কার।
তাইপিং আন্দোলনকে বিপ্লব আখ্যা দেয়া যায়ঃ
তাইপিং আন্দোলনকে চীনের একাধিক কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে অন্যতম বিদ্রোহরূপে চিহ্নিত করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। তাইপিংগণের লক্ষ্য ছিল মাঞ্চুদের উচ্ছেদ করা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন করা। তাদের আদর্শগুলি বিপ্লাবত্মক। তাই তাইপিং আন্দোলনকে বিপ্লবদ্যোতকই বলা যায়। যেমন বলেছেন মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডড়ষভমধহম ঋৎধহশব. কার্লমার্কস এই আন্দোলনকে রুশ বিপ্লবের পর্যায়ভূক্ত মনে করেন।
উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, তাইপিং বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও মাঞ্চু শাসকদের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এ বিদ্রোহের বৈপ্লবিক রূপকে অনেকটা সফলতা দেয়। এর ফলে চীনের ইতিহাসে এক নবযুগ প্রতিষ্ঠার দ্বার উম্মোচিত হয়। এবং সে পথ ধরেই ১৯১১ সালে চীনের জন্ম হয়। সুতরাং তাইপিং বিপ্লব চীনের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক হয়ে আছে। ইস্রায়েল এপ্স্টেইন যথাযথ-ই বলেছেন, “ঞযব ঞধরঢ়রহম ঁঢ়ৎরংরহম রিষষ ঃধশব রঃং ঢ়ষধপব রহ ঃযব পড়হংপরয়ঁংবংং ড়ভ ধষষ ঢ়বড়ঢ়ষব ধং ড়হব ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ’ং মৎবধঃ ধিৎং ভড়ৎ যঁসধহ ভৎবফড়স.
Plz upload ১৯৯৪-৯৫ এর চীন-জাপান যুদ্ধ আর আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা (OAU). ধন্যবাদ।
৫ এপ্রিল, ২০১৪ এ ১০:০৯ PM
THANKS
২৪ জানুয়ারী, ২০১৭ এ ১১:১৪ AM
লর্ড ডালহৌসি কি ভাবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও তার আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ধন্যবাদ।
৩১ অক্টোবর, ২০১৭ এ ১০:৫১ AM
টিকা জাপানি কোকুতাই তত্ত্ব কি?
৩ নভেম্বর, ২০১৭ এ ১০:০৮ AM
THANKS
২৬ মার্চ, ২০১৯ এ ১২:৪৯ AM
কোকুতাই কী
৪ এপ্রিল, ২০১৯ এ ৭:৩৩ PM
Source name please
১ জানুয়ারী, ২০২২ এ ৫:৫৩ PM