চীনের ইতিহাসে আফিম একটি উল্লেখ যোগ্য পন্য। আফিমের ব্যবসা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাছাড়া আফিমের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যে যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল তা পুরো চীনের গতি ধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল শুধু তাই নয় আফিমের যুদ্ধ ছিল চীনের জন্য একটি দুর্বিসহ অধ্যায় ছিল। যে চীনা সাম্রাজ্যে কোন বিদেশী প্রবেশ করতে হলে চীনা সম্রাটকে নজরানা দিয়ে প্রবেশ করতে হত সেই চীনে আফিমের যুদ্ধের পরবর্তী যুগে বিদেশী শক্তিবর্গ পুরো চীন সাম্রাজ্যকে অর্ধ উপনিবেশে পরিনত করেছিল। চীন হয়েছিল পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদের খোরাক। একে একে বৃটেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সর্বশেষ রাশিয়াও চীনকে ধরাশায়ী করে তোলে। সে সময় চীনা সম্রাট চিয়া চিং পালিয়ে বাঁচে এবং তার ছোট ভাই বিদেশীদের সাথে মহা অসম চুক্তি করে একপ্রকার দেশকে বিদেশের হাতে তুলে দিয়ে নিজ দেশে পরাধীন থাকার মত বেঁচে থাকে। নিচে আফিম, আফিমের ব্যবসা, আফিমের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী চুক্তি ব্যবস্থা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।
আফিম আসলে কি ঃ
আফিম আসলে এক প্রকার ড্রাগ জাতীয় পণ্য। যা বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি অধিক মাত্রায় ব্যবহার করলে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যাইহোক আফিমের মূলত পরিচয় মাদক হিসেবে। যা সেবন করলে মানুষের সাময়িক মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে থাকে। তার দীর্ঘ দিনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ভিতরগত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে মানুষ একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে দেখা যায় আফিম শুধু চীনের মানুষকে নিঃশেষ করেনি বরং পুরো চীন সাম্রাজ্যকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
চীনে আফিমের ব্যবহার শুরু থেকে শেষ ঃ
চীনে আফিমকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হত। যেমন, ণরহম, গর-হধহম, অ-ঋঁ-ুঁহম এবং চড়-ঢ়র বা চড়ঢ়ঢ়ু. বিশেষত চীন দেশে সর্বপ্রথম সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে আফিম আমদানি করা হত আরব এবং তুর্কী দেশ থেকে। সে সময় চীনের মানুষ এটাকে বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত। তখন মাদক হিসেবে এর ব্যবহার চীনা জানত না। পরবর্তীতে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত তথা বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমানে মাদক চীনে চোরা চালান হত। চীনারা আফিমকে নেশা জাতীয় দ্রব্য হিসেবে খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছিল। সে সময় নেশা জাতীয় পণ্য হিসেবে শুধু মাত্র অভিযাত ও আরামপ্রিয় লোকজন এটাকে গ্রহণ করে। চীনা সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আফিমের চোরা চালানী বন্ধ করার চেষ্টা করলেও তা বন্ধ তো হয়নি বরং বিভিন্নভাবে বিদেশী কোম্পানি গুলো আফিমের চোরা চালান বৃদ্ধি করেছিল। তখন আর শুধুমাত্র আরামপ্রিয় ও অভিযাত লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আফিমের চোরাচালান মারাত্মক হারে বেড়ে গিয়েছিল। যা একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে সাম্যক ধারণা লাভ করা যায়।
১৮০০ খৃষ্টাব্দে চীনে আমদানীকৃত আফিমের পরিমান ছিল ২,০০০ পেটি, ১৯২০ সালে এই পরিমান বেড়ে গিয়ে দাড়ায় ১০,০০০ পেটি, ১৮৩০ সালে ২০,০০০ পেটি এবং যুদ্ধ পূর্ববর্তী ১৮৩৮ সালে তার পরিমান দাড়িয়েছিল ৪০,০০০ পেটিতে। এক একটি পেটিতে ১৪০ থেকে ১৬০ পাউন্ড আফিম থাকতো।
একপর্যায়ে দেখা গেল যে কোয়াংটুং এবং ফুকিয়েন প্রদেশে ১০ জনের ৯ জন লোকই আফিমের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার মধ্যে সরকারী কর্মচারীও অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। একজন সাধারণ নেশাখোর মজুর শ্রেণীর লোক দিনে .১০ থেকে .২০ টেইল খরচ করত শুধু আফিমের পিছনে। আবার কেউ কেউ এর দ্বিগুন পরিমান অর্থ খরচ করত আফিম ক্রয়ের জন্য। এক চীনা পরিসংখ্যানে দেখা যায়- ১৮২৩ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে চীনে গড়ে প্রতিবছর ১৭-১৮ মিলিয়ন টেইল ব্যয় হত আফিমের পিছনে। ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৪ সালের মধ্যে সে মাত্রা বেড়ে গিয়ে দাড়ায় ২০ মিলিয়ন টেইলে। যা ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সালের মাধ্যে চরমভাবে বেড়ে গিয়ে দাড়ায় ৩০ মিলিয়ন টেইলে।
আফিমের ব্যবসা শুরু এবং তার ধারাবাহিকতা ঃ
পূর্ব থেকেই পশ্চিমাদেশগুলো চাচ্ছিল যেকোন ভাবে চীন দেশে বাণিজ্য করতে। কিন্তু চীনের রুদ্ধদ্বার নীতির কারণে পশ্চিমাদেশগুলো সুযোগ পাচ্ছিল না তাদের সাথে ব্যবসা করতে। মূলতঃ চীন ছিল এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সবকিছুই উৎপন্ন হত। যেকারণে বৈদেশিক বাণিজ্য তাদের তেমন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশ বৃটেইনসহ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশগুলো চেয়েছিল চীনের সাথে বাণিজ্য করতে। কারণ চীনের কাঁচামাল নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বেশি লাভাবান হচ্ছিল। শুধু তাই নয় পশ্চিমাদের মূল আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল চীনের বন্দরগুলো ব্যবহার করা।
বাঁধা হলো চীনের সম্রাটের সাথে দেখা করতে বা কোন চুক্তি করতে গেলে সে দেশেরই কর্মকর্তা বা যাই হোক না কেন তাকে অবশ্যই চীনের প্রচলিত প্রথা তথা কাউটাউ প্রথা মেনে অর্থাৎ হাটু গেড়ে রাজাকে কুর্ণিশ করে নজরানা দিয়ে দেখা করতে হয়। এতসব অপমান মেনে নিয়েও তারা চীনের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল। উল্লেখ্য যে, বৃটেইন থেকে ১৭ বার কর্মকর্তারা সম্রাটের সাথে দেখা করতে গিয়ে ১৬ বারই তাদের এই প্রথা মেনে নিতে হয়। বিদেশীদের উদ্দেশ্য একটাই চীনের সাথে বাণিজ্য করা।
এরই ধারাবাহিকতায় বৃটেইন বিভিন্ন শর্ত মেনে নিয়ে চীনে বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। তারা এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণ আফিম চোরাই চালান করতে সক্ষম হয়। এ সময় ভারত বর্ষে একচেটিয়া আফিমের চাষ শুরু হয়। যদিও চীন সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এ চোরাই চালান বন্ধ করার চেষ্টা করেন কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা পুরোটাই ব্যর্থতায় রূপ নেয়।
চীনে আফিমের ব্যবসার কি প্রভাব পড়েছিল চীনে ঃ আফিম ব্যবসার কারণে চীনের উপর যে কুপ্রভাব দেখা দিয়েছিল তা হলো-
প্রথমতঃ চীনে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বণিকগণ আফিমের চোরাই চালান শুরু করেছিল মূলত ১৭৮০ সালের দিকে। প্রথম দিকে চীনারা চা, রেশম, চীনা মাটির বাসন ও অন্যান্য পণ্য সামগ্রী দিয়ে বিদেশী বণিকদের নিকট থেকে আফিম ক্রয় করত। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে চীনে আফিমের চাহিদা এত অধিকহারে বেড়ে গিয়েছিল যে, তখন তাদের আর উৎপাদিত পণ্য দিয়ে আফিমের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সুতরাং তারা রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে আফিম ক্রয় করতে শুরু করে। এতে চীনা রৌপ্যের ভাণ্ডার বিদেশে চলে যেতে থাকে। ফলে চীনে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবার আশংকা চলে আসে।
দ্বিতীয়তঃ চীনা জনগণের আফিমের প্রতি নেশা এত অধিক হারে তৈরি হয়েছিল বিশেষ করে যুব সমাজ একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
তৃতীয়তঃ এর মাধ্যমে বিদেশী বণিকরা চীনে প্রবেশ ও স্থান নেয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। যেটা আসলে চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রেনের বাইরে চলে যাবার আশংকা ছিল।
আফিম ব্যবসা প্রতিরোধে মাঞ্চু সরকার কি পদক্ষেপ গ্রহন করে ছিলেনঃ
প্রথমতঃ মাঞ্চু সরকার আফিম চোরাচালানের মারাত্মক কুফল বুঝতে পেরে ১৮০০ সালের দিকে চীনা সম্রাট চিয়া চিং চীনে আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে বহু চীনা জনগণ আফিমে মারাত্মক ধরণের আসক্ত হয়ে পড়ে এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আফিমের ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হয়েছিল। এরমধ্যে কিছু রাজকর্মচারীও জড়িত ছিল। সুতরাং তারা এত অর্থের লোভ ছাড়তে না পেরে উৎকোচের মাধ্যমে আফিমের চোরাইচালান ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকল। ফলে সরকারে আইন শুধু আইনই থেকে গেল। বাস্তবে কোন ফল হলো না।
দ্বিতীয়তঃ আফিমের চোরাই চালান বন্ধের প্রথম পদক্ষেপ কোন যখন কোন কাজে আসল না অপরদিকে অর্থনৈতিক সংকট যখন চরমে উঠে তখন জীবন যাত্রার মান যাতে নীচে নেমে না আসে সে জন্য ভূ-স্বামীগণ ভূমি করের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। তাতে দেশে আরো বেশি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে মাঞ্চু সরকার আফিমের চোরাই চালান বন্ধ করার জন্য চুড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখলেন না। সুতরাং মাঞ্চু সম্রাট চিয়া চিং ক্যান্টন বন্দরে একজন যোগ্য ও দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা লিন-সে-সু (খরহ-ঞংব-ঝঁ) কে নিয়োগ দেন। লিন-সে-সু দ্রুত গতিতে এই আফিম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বিদেশী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কঠোর আইন তৈরি করে। সেই আইনগুলি হলো-
কোন বিদেশী যুদ্ধজাহাজ চীনে প্রবেশ করতে পারবে না।
বিদেশী ফ্যাক্টরিগুলিতে কোন বন্দুক বা অস্ত্রসস্ত্র রাখা চলবে না।
বিদেশীদের সমস্ত জাহাজ চীনে রেজিষ্ট্রি করাতে হবে।
প্রতিটি বিদেশী ফ্যাক্টরিতে চীনা ভৃত্যের সংখ্যা বেধে দেওয়া হবে।
তা সত্ত্বেও আফিমের বেআইনি ব্যবসা বন্ধ কর গেল না। ১৮৩৯ সালে ১০ ই মার্চ ৫৪ বছর বয়সী লিন-সে-সু ক্যান্টন শহরের যে অঞ্চলে বিদেশী বাণিজ্য সংস্থাগুলো গড়ে উঠেছিল সেই অঞ্চল তিনি অবরোধ করেন। বণিকদের নিকট রক্ষিত সকল বেআইনী আফিম ছিল তা তিনি তাঁর হেফাজতে সমার্পন করার নির্দেশ দেন। বিদেশী বণিকেরা পরিস্থিতির চাপে পড়ে ২০,০০০ পেটি আফিম লীনের কাছে জমা দিতে বাধ্য হয়। ১৮৩৯ সালে ২ জুন লিন-সে-সু জন সমক্ষে লবন ও চুন দিয়ে বিশাল পরিমান আফিম ধ্বংস করে দেন। যার বিনিময় মূল্য ছিল প্রায় ৬ মিলিয়ন টেইল। এটি ছিল আফিম যুদ্ধের প্রধান কারণ।
আফিমের যুদ্ধঃ চীনে আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধই হচ্ছে আফিমের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু এ যুদ্ধ চীনাদের কাছে আফিমের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হলেও পশ্চিমা বণিকদের নিকট এ যুদ্ধ ছিল বাণিজ্য যুদ্ধ। অর্থাৎ একই যুদ্ধ দুই পক্ষের নিকট ভিন্নভাবে পরিচিতি পেয়েছে।
আফিম যুদ্ধের জন্য মূলত যে সকল কারণ দায়ি ছিলঃ
আফিম যুদ্ধের প্রথম এবং প্রধান কারণ বর্ণনা করেছি। সেটা হলো বণিকদের বিশাল পরিমান আফিম চীনা কমিশনার কর্তৃক ধ্বংস যা বিদেশী বণিকদের নিকট নিতান্তই অপমান জনক।
দ্বিতীয় কারণ ছিল ব্রিটিশ বিণিকদের হাতে একজন চীনা নাগরিক নিহত হয়। এ ক্ষেত্রে কমিশনার এলিয়ট (বৃটেনের) ন্যায় বিচার না করে প্রহসনমূলক বিচার করলে বৃটেনের কমিশনার ক্ষেপে যায়।
কোন ঐতিহাসিক এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে আফিম ব্যবসাকে এককভাবে দায়ি না করে বরং এর পিছনে আরো কিছু কারণের অবতারণা ঘটান। যেমন তারা মনে করেন যে, চীনের নজরানা প্রথা, ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা এবং কাউটাউ প্রথাও এ যুদ্ধের পিছনে অন্যতম কারণ।
আবার কোন কোন ঐতিহাসিক এ কারণগুলোর কোনও কারণকে মূল কারণ হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ। বরং তারা এগুলোকে শুধু মাত্র অজুহাত হিসেবে ব্যবহার স্বীকার করেন। এবং মূল কারণ হিসেবে তারা মনে করেন যে, বৃটেন তথা পশ্চিমা বিশ্বের মূল টার্গেট ছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের জন্য তারা কোন একটি কৌশল এবং অজুহাত খুঁজতেছিল। এবং আফিম ব্যবসা ছিল এরই একটি পূর্ব কুটচাল বা একটি ফাঁদ। যে কারণে চীনারা বার বার পদক্ষেপ নিয়েও আফিমের ব্যবসা বন্ধ করতে পারেনি। এর আগেও তারা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করতে এসে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতা বিস্তার করে ছাড়ে।
কারণ বা অজুহাত যেটাই হোক না কেন ১৮৪০ সালে এ্যাডমিরাল এলিয়টের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রচুর সৈন্য ও অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে চীনে আক্রমন করে। চীনারা এই আক্রমন প্রতিহত করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়। এভাবে প্রথম ঈঙ্গ-চীন যুদ্ধ তথা প্রথম আফিমের যুদ্ধ সূচনা ঘটে। ইমানুয়েল সু বলেছেন, “এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে চীনারা বেআইনী আফিমের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল।” মূলত সে কারণেই ঐতিহাসিকরা এ যুদ্ধকে প্রথম আফিম যুদ্ধ হিসেবে নামকরণ করেছেন। যাইহোক চীনারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সঙ্গে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেও এলিয়টের নেতৃত্বাধীন বৃটিশ বাহিনীর যুদ্ধ কৌশল এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের নিকট পরাজিত হয় চীনা বাহিনী। এ যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ চীনা সৈন্য এবং মাত্র ৫০০ বৃটিশ সৈন্য নিহত হয়।
যুদ্ধ অবসান হয় যেভাবেঃ
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীনা সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য চীনা সম্রাট চিয়া চিং দ্রুত ইংরেজদের সাথে শান্তি স্থাপনে ব্যগ্র হন। প্রথমেই দেশপ্রেমিক লিন সে সুকে পদচ্যুত করে নির্বাসিত করা হয় এই অপরাধে যে তার ‘হঠকারী পদক্ষেপ’ এই যুদ্ধের জন্য দায়ি। এরপর চীনা সামন্ততান্ত্রিক সরকার কতকগুলো অপমানজনক শর্ত মেনে নিয়ে বৃটিশদের সাথে একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। যে চুক্তিটি নানকিং এর চুক্তি নামে পরিচিত। ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্টে নানকিংয়ের চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রথম আফিমের যুদ্ধের আবসান হয়।
নানকিং সন্ধিঃ
ইংরেজরা চীনের নিকট থেকে মোট ২১ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার ক্ষতিপূরণ হিসাবে লাভ করে। এই ২১ মিলিয়নের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সামরিক ক্ষতিপূরণ ১২ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার, লিন কর্তৃক বিনষ্ট আফিমের মূল্য ছিল ৬ মিলিয়ন রৌপ্য ডলার এবং ক্যান্টনে হং বণিকদের বকেয়া ঋণ শোধের জন্য দিতে হয়েছিল ৩ রৌপ্য ডলার।
ক্যান্টনে কো-হং এর একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।
ক্যান্টন, অ্যাময়, ফু-চাও নিংপো, সাংহাই- এই পাঁচটি বন্দরই ইংরেজদের কাছে উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, ব্রিটিশ কনসাল, বণিকেরা এবং তাদের পরিবারবর্গ এই অঞ্চলগুলিতে বসবাস করতে পারবে।
হংকং ইংরেজদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুই তরফের মধ্যে সরকারী চিঠিপত্রের ব্যাপারে সমতা স্বীকৃত হয়।
বিদেশী পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করা হবে এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
যুদ্ধ পরবর্তী বিদেশী প্রভাবগুলো কি ছিল এবং তার ফলে কি হলঃ
বোগের সন্ধি চুক্তিঃ
১৯৪৩ সালের ১৮ অক্টোবর নানকিং সন্ধি চুক্তির সম্পূরক একটি সন্ধি চুক্তি চীন ও বৃটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধি চুক্তি বোগের সন্ধি চুক্তি নামে অভিহিত। এই সন্ধির শর্তসমূহ-
১. আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যের উপর ৪ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হবে। রপ্তানিকৃত পণ্যের নির্ধারিত শুল্কের পরিমান হবে ১.৫০ শতাংশ থেকে ১০.৭৫ শতাংশ।
২. ব্রিটিশরা চীনে “অতি আঞ্চলিক অধিকার” (ঊীঃৎধ ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ জরমযঃ) লাভ করে। অর্থাৎ ব্রিটিশ কনসালরা চীনে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করতে পারবে।
৩. ইংল্যান্ডকে চীনে সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশের মর্যাদা দেওয়া হয়। বোগের সন্ধি চুক্তিকে হুমেনের সন্ধি চুক্তি বলেও অভিহিত করা হয়।
ওয়াংশিয়ার সন্ধি চুক্তিঃ
নানকিং চুক্তির পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বণিকেরা চীনে কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। ১৮৪৩ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কালেব কাশিং নামে বৈদেশিক দপ্তরের এক পদস্থ কর্মচারীকে চীনে পাঠায়। তার সঙ্গে আরও একজন সঙ্গি ছিলেন। তারা মাঞ্চু সরকারের কাছে আর্জি রাখেন যে, বৃটেনকে চীনে যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে আমেরিকাকেও সে সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। ১৮৪৪ সালের মে মাসে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ চীন অভিমুখে আসতে থাকে। সন্ত্রস্থ চীনা সরকার আমেরিকার সাথে একটি অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৮৪৪ সালের জুলাই মাসের চীন ও আমেরিকার মধ্যকার এ চুক্তিকে ওয়াংশিয়া চুক্তি বলা হয়।
সন্ধির শর্তবলীঃ
চীনে বসবাসকারী কোন মার্কিন নাগরিক যদি কোন চীনার সাথে কোন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তার বিচার করবেন আমরিকান কনসাল। একজন আমরিকান অপরাধীকে বিচার করার এক্তিয়ার চীনা আদালতের থাকবে না।
আমদানিকৃত বা রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার সময় বা এই শুল্কের হার পরিবর্তনের সময় চীনা সরকারকে আমরিকান কনসালের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। অর্থাৎ শুল্ক ধার্য করার স্বাধিকার চীন সরকার চীন সরকার হারাতে বাধ্য হল।
বিদেশী বাণিজ্য-জাহাজ যখন তখন চীনের অভ্যান্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়াই চীন ছাড়তে পারবে। তাছাড়া আমরিকানরা পাঁচটি উম্মুক্ত বন্দরে তাদের গির্জ বানাবার অধিকার লাভ করে। বার বছর পর এই সন্ধির চুক্তি পুনর্বিন্যাস করা হবে।
হোয়াম্পেয়ার সন্ধিঃ
একইভাবে ব্রিটিশরা নানকিং সন্ধির মাধ্যমে এবং আমেরিকানরা ওয়াংশিয়া সন্ধির মাধ্যমে যে সুযোগ সুবিধা লাভ করে ফরাসীরাও হোয়াম্পেয়ার সন্ধির মাধ্যমে একই সুযোগ সুবিধা আদায় করে ছাড়ে। বরং তারা আরও কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা লাভ করে। যেমন চীনের পাঁচটি বন্দরে পাঁচটি ক্যাথলিক গির্জা তৈরির অনুমতি লাভ করে।
পরিশেষে যুদ্ধের চুড়ান্ত ফলাফল হিসেবে আমি বলতে পারি যে চীনা চিং সরকার প্রথম আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে তারা কতকগুলো অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হল। তদুপুরি চীনে আফিমের ব্যবসাতো বন্ধ হলোই না বরং তা আরও ব্যাপক হারে বেড়ে গেল। অসম চুক্তির মাধ্যমে চীন তার নিজস্বতা হারাল, কাউটাউ প্রথা বিলুপ্ত হল, নজরানা প্রথা বিলুপ্ত হল। শুধু তাই নয় এখন চীনকেই উল্টো বিদেশী শক্তিগুলোকে সম্মান দিতে হচ্ছে। সর্বোপরি তার চুড়ান্ত ফলাফল হল দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ।
আরো একটু বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলে ভালো হয়।
১৯ জানুয়ারী, ২০১৯ এ ৬:৪৭ PM
দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ নিয়ে বলেন
২২ জুলাই, ২০১৯ এ ১১:২৯ AM
দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ নিয়ে বলেন
২২ জুলাই, ২০১৯ এ ১১:২৯ AM
ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা বরাবরই উপনিবেশিক। এটাই তার প্রমান। চুরি ডাকাতি করে খাওয়াই তাদের অভ্যাস।
২৭ আগস্ট, ২০১৯ এ ২:৪১ AM
very informative
২৩ নভেম্বর, ২০১৯ এ ৭:২০ PM
তামাকের হাঙ্গামা বলতে কি বোঝ?
৩১ মে, ২০২০ এ ৮:২৩ AM
দিন সে সু কে
১২ মার্চ, ২০২১ এ ৯:৩০ PM