Blogger Templates by Blogcrowds

চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪

ভূমিকা:
চীনের ইতিহাসে ১৯১১ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে চীনের মাটি ক্রমশ প্রজাতান্ত্রিক বীজ বপনের ফলে আশানুরূপ উর্বর হয়ে উঠে। যদিও অনেক পূর্ব থেকেই চৈিন প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলন সূচিত হয়। পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে সংস্কার সাধন, আত্মশক্তি বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেসবের কার্যকারিতা এবং প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের তৎপরতা চীনে এক আসন্ন বিপ্লবাত্মক বিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। যার পরিণতি ঘটে ১৯১১ সালের প্রত্যাশিত বিপ্লব। অত:পর ১৯১২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি চিং সম্রাট তুং এর রাজ্যত্যাগের সঙ্গে চীনের মাঞ্চু বা চিং শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রজাতাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মূলত বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলশ্র“তি।

চীনের ১৯১১ সালের প্রজাতন্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমি:
১৯১১ সালে চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমি আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইম্যানুয়েল সু বলেছেন উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে চীনের ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন  জাতীয় অবমাননার ইতিহাস, ১৮৪২ সালের নানকিং সন্ধিচুক্তি থেকে শুরু করে ১৯০১ সালের বক্সার প্রটোকল পর্যন্ত বিদেশী শক্তিবর্গের সাথে অসংখ্যা অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল চীন। তাছাড়া ১৮৮০ এবং ৯০ এর দশকে করদরাজ্যগুলো চীনের হাতছাড়া হয়েগিয়েছিল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে দেশ নিজেকে পৃথিবীর ‘মধ্য রাজ্য’ (গরফফষব করহমফড়স) বলে দম্ভ করত, মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সে দেশ বৃহৎ শক্তিবর্গের আধা-উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। ১৬৪৪ সালে মাঞ্চুরা বিজেতা হিসেবে চীনে প্রবেশ করেছিল এবং রাজতান্ত্রিক শাসনকে মেনে নিতে পারেনি। পাশ্চাত্য দেশের রাজনৈতিক বিবর্তন চীনের প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ইংল্যান্ডের এষড়ৎরড়ঁং জবাড়ষঁঃরড়হ (১৬৮৮), আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন (১৭৭৫-৮৩) এবং ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) চীনা জাতিকে মাঞ্চু শাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য আন্দোলন করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দীতে গ্রীসের স্বাধীনতা যুদ্ধ, জুলাই বিপ্লব (১৮৩০), ফেব্র“য়ারি বিপ্লব (১৮৪৮) এর মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিজয় ১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউন প্রতিষ্ঠা ঘটনা চীনা জনসাধারণের জন্য সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল। এ সকল পাশ্চাত্য আন্দোলন থেকে চীনারা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার রাজনৈতিক সমতা ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে এবং স্বদেশের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের পথে পা বাড়ায়। ১৮৭০ সালে অষ্ট্রিয়ার কাছ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইতালি ও জার্মানীতে স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে ইতালি ও জার্মানির সাফল্য চীনাদের মনে প্রভৃতি আশা ও উদ্দীপনা সঞ্চার করে। ইতালি ও জার্মানিতে যা সম্ভব, চীনেও তা সম্ভব এ আশাবাদ মাঞ্চু বিরোধী আন্দোলনে প্রেরণা যোগায়। ১৯০৫ সালে প্রাচ্যশাক্তি ক্ষুদ্র জাপানের হাতে বৃহৎ পাশ্চাত্য শক্তি রাশিয়ার পরাজয় চীনাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করেছিল। রাশিয়ার স্বৈরাচরী জারের বিরুদ্ধে দরিদ্র রুশ জনতার অভ্যুত্থান চীনের সশস্ত্র বিপ্লবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সমসাময়িক বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ চীনারা নিজেদের দেশে একটি পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য উম্মুখ করে তুলেছিল। ‘আর রাজতন্ত্র নয় প্রজাতন্ত্র’ এই আদর্শ চীনা বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে।
চীনে ১৯১১ সালে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের কারণ:
১৯১১ সালে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের বীজ ছিল দীর্ঘকালের। চীনে একটি প্রচলিত প্রবাদ ছিল যে, যখন ইশ্বরের আশীর্বাদ কোন রাজবংশের উপর থেকে প্রত্যাহার হয় তখন দেশে নানা বিপর্যয় ঘটে। চীনা জনগণ বিশ্বাস করত যে চিং রাজবংশের উপর থেকে ইশ্বরের নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এজন্য বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চীন বিপর্যস্থ, জনসংখ্যার ভারে এ দরিদ্র জনসাধারণ বিপন্ন, ক্লান্ত ও হতাশাগ্রস্ত। চিং রাজবংশ জনগণের আস্থা হারিয়েছিল। নৈতিক ভিত্তি নষ্ট হওয়ার ফলে বংশের পতন অবশ্যম্ভাবি হয়ে পড়ে। ১৯১১ সালে চীনা জনগণ দ্বারা প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। নিম্নে এই চীনা প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের কারণগুলো আলোচনা করা হলো।
মাঞ্চুবিরোধী মনোভাব:
১৬৪৪ সালে যখন চীনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনাধীন হয় কারণ মাঞ্চুরা ছিলেন বহিরাগত, তাদের ধর্মনীতিতে চীনা রক্ত প্রবাহিত ছিলনা। এ ক্ষেত্রে আত্মসম্ভ্রমশীল চীনাজাতির মধ্যে মাঞ্চু বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠাই স্বাভাবিক। ১৯১১-১৯১২ সালে বহু পূর্ব থেকেই চীনা চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ যথা, কু ইয়েন-উ,  উয়াং ফুচি  মাঞ্চুবিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন। অনেক গুপ্ত সমিতির বার্যকলাপও ছিল মাঞ্চু বিরোধী, যথা ‘ঞযৎবব ভবঁফধষড়ৎরবং সমিতি ট্রেয়াল সমিতি’ (ঃৎরধফ ংড়পরবঃু  বা ঐবধাবহ ধহফ ঊধৎঃয ঝড়পরবঃু) শ্বেতপদ্ম সমিতি (ডযরঃবং ষড়ঃঁং ংড়পরবঃু) ১৮৫০-৬৪ সালে তাইপিং বিদ্রোহ ছিল মাঞ্চুবিরোধী।
ঐতিহ্যবাহী সংগ্রাম:
চীনে মাঞ্চুবিরোধী সংগ্রামের একটি পুরাণ ঐতিহ্য ছিল। মাঞ্চুচীনারা এ ধারণা পোষণ করতেন যে, বিদেশী মাঞ্চুরা চীনা মিং রাজবংশের উচ্ছেদ সাধন কর চিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিল। চিং রাজতন্ত্র তাদের কাছে ছিল একটি বিদেশী রাজতন্ত্র। বিভিন্ন অনুগতদের বিদ্রোহ স্বর্গ উমর্ত সমিতির কার্যাবলী। শ্বেতপদ্ম সমিতির বিদ্রোহ এবং তাইপিং বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ছিল একটি জাতিগত এবং জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদের প্রকাশ। সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বাধীন ১৯১১ সালের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেও এই মাঞ্চু বিরোধী ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছিল।
চিং স্বৈরতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতা ও দুর্ণীতি:
দীর্ঘ সময় ধরে চিং সরকার ছিল জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন, দূর্ণীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত। রাজধানী পিকিং এ চিং সম্রাট তার রাজদরাবারে আড়ম্বর আদব-কায়দা ও সমর্থক শাসক গোষ্ঠির দ্বারা পরিবৃত থাকতেন। চীনা দেশপ্রেমিক ও সংস্কারবাদীগণ মাঝে মাঝে সিংহাসনের কাছে যুগোপোযোগী সংস্কার দাবি জ্ঞাপন করলেও সম্রাজ্ঞী জু-সি সে সকল দাবি অগ্রাহ্য করেন। ফলে চিং শাসন ব্যবস্থা একটি জড়, গতিহীন, প্রাণশক্তিহীন শাসনব্যাবস্থায় পরিণত হয়। সংস্কারের অভাবে সরকারের রন্দ্রে রন্দ্রে যে দূর্ণীতি ও পাশ্চাত্যগামিতা দেখা দেয় তা দুর করা যায়নি। সম্রাজ্ঞীর দৈবাধিকার স্বত্ত্ব এবং চিং কর্মচারীদের কায়েমী সরকারকে একটি স্বৈর শাসনের পেষণ যন্ত্রে পরিণত করে। জনকল্যাণ ও প্রজাপালনের দায়িত্ব গৌণ স্থানে চলে যায়। এমতাবস্থায় জনগণ এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
সান ইয়াৎ সেনের অনুপ্রেরণাঃ
প্রজাতান্ত্রিক চীনের প্ররুধা ড: সান ইয়াৎ সেন চীনের মানুষকে একই বৃত্তের আবর্তে ঘুরছ। এক রাজবংশ অপর রাজবংশকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করছে কিন্তু রাজতান্ত্রিক শাসন অক্ষুন্ন রয়েছে। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতির হাত থেকে এবং সাম্রজ্যবাদী শৃঙ্খলের বন্ধন থেকে চীনকে মুক্ত করতে হলে নতুন উদ্ভাবণী শক্তির পরিচয় দিয়ে শাসন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আনা দরকার। একমাত্র প্রজাতন্ত্র গঠনের মাধ্যমেই চীনের জনগণের আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত হতে পারে।

চৈনিকদের আধুনিক শিক্ষা লাভঃ
চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিল চৈনিকদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। ১৮৩৬ সাল থেকে চীনারা আধুনিক শিক্ষা লাভের জন্য টোকিওতে পাড়ি দিতে শুরু করে। যদিও ১৮৯৮ সালে জাপানে চীনের ছাত্রের সংখ্যা মাত্র ১৮ জন হলেও ১৯০৬ সালে তা ১৩,০০০ বা তারও বেশি ছিল। জাপানে প্রাপ্ত শিক্ষা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা, যে শিক্ষা চীনা জনগণকে বহুলাংশে সংস্কারমুক্ত করে। প্রজাতন্ত্র বিশ্বাসী করে তোলে বহু পাশ্চাত্য গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনূদিত হওয়ার ফলে চীনারা শাসনের শেষের দশকে হাজার হাজার চীনা যুবক জাপানে পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন সামরিক নীতি এবং শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত শিক্ষা লাভ করে। জাতীয়তাবাদ উদ্বুদ্ধ হয়।
জাপানের আধুনিকতা অনুসরণঃ
১৮৭৬ সালে মেইজিযুগ প্রবর্তনের স্বল্পকালের মধ্যেই জাপান মধ্যযুগীয় পরিবেশ ত্যাগ করে আধুনিকযুগে প্রবেশ করে। জাপান আধুনিক যুগে প্রবেশাধিকার পায় পাশ্চাত্য সভ্যতা গ্রহণের ফলে। জাপানের আধুনিকায়নের গতি এত দ্রুত হয় যে, উনবিংশ শতক অতিক্রান্ত হবার পূর্বেই চীনকে জাপানের নিকট পরাজিত হতে হয়। জাপানের এ অগ্রগতি অব্যাহত থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল পর্যন্ত। জাপানের এই অগ্রগতি চীনকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে। জাপানের অনুকরণে চীনও মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা ত্যাগ করে সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক শিক্ষা সংক্রান্ত প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য ধাঁচে সংস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশের আধুনিকিকরণে বদ্ধ পরিকর হয়। এই আধুনিকীকরণ চীনা জাতিকে অনুরূপ অগ্রগতি সাধনে প্রেরণা দেয়। সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে ১৯১১ সালে চীনা বিপ্লবের ক্ষেত্র রচিত হয় জাপানে।
জাপানের প্রভাবঃ
প্রাক-প্রজাতন্ত্রী বিপ্লবযুগে চীনের উপর জাপানি প্রভাব বিস্তৃত হবার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, জাপানে তৎকালে একটি আন্দোলন শুরু হয় যার উদ্দেশ্য চীনকে ভালভাবে জানা এবং চীনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষায় এবং রাজনৈতিক সংস্কার তথা অর্থনৈতিক আধুনিকিকরণ সাধনে সহায়তা করা। এই উদ্দেশ্যে জাপানে গঠিত হয় একটি সংগঠন ঞড়ধ উধনঁহ কধর পূর্ব এশিয়া সাধারণ সংস্কৃতি। এই সংগঠনটি স্থাপিত হয় ১৮৯৮ সালে। এর কার্যক্রম অনুসারে টোকিও, কিয়োটো প্রভৃতি শহরে চীনের ইতিহাস আলোচনার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এতদ্ব্যতীত চীন সম্পর্কে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয় তাইওয়ান মুকডেস এবং সাংহাই অঞ্চলে। ফলে চীন জাপানের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে এবং জাপানের উচ্চতর প্রভাব প্রতিফলিত হয় চীনের উপর। যার ফলশ্র“তি ১৯১১ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব।
মুৎসুদ্দি শ্রেণীর সহায়তাঃ
বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের দ্বারা চীনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবার ফলে চীনে কিছু নতুন সামাজিক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল। চীনে লগ্নি পুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবার সাথে মুৎসুদ্দির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। এই মুৎসুদ্দি শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থ যেহেতু বৈদেশিক উদ্যোগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই বিদেশী শক্তিবর্গের উপর চীনের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বজায় রাখতে চেয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চীনে চীনা মালিকানাধীন বেশ কিছু হাল্কা শিল্প গড়ে উঠে। এগুলোর মধ্যে বস্ত্রশিল্প এবং ময়দা কল ছিল প্রাধান। এই সমস্ত জাতীয় পুঁজিপতির একটি স্বাধীন স্বনির্ভর এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী চীন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তারা মাঞ্চু রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকার গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিল। মুৎসুদ্দিদের সঙ্গে জাতীয় পুঁজিপতিরা এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য ছিল। তারা সান এর প্রজাতন্ত্র গঠনের আহবানকে স্বাগত জানিয়েছিল।
চিং সরকারের সংস্কার বিমুখতাঃ
বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো চীনের উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী ফাঁস লাগিয়ে চীনের স্বাধীনতা ও সভ্যতাকে ধ্বংশ করতে উদ্যত হয়। চিং সরকার এই বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হন। তারা আধুনিক সংস্কার ও জনপ্রতিনিধি সভা দ্বারা সরকারকে মজবুত করতে বিরত থাকেন। ১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে চীনের শোচনীয় পরাজয়ে চীন সরকারের পতনের প্রথম ঘন্টা ধ্বনিত হয়। এ সময় নবীন সম্রাট কোয়াং সু, কাং ইউ ওয়ের সাহায্য একশ দিবসের সংস্কার প্রচেষ্টার পর রক্ষণশীলদের বাধায় ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে সংস্কারপন্থী যারা আধুনিক সংস্কার দ্বারা চিং সরকারকে বাচাবার আশা করেন তারা হতাশাগ্রস্ত হন। এভাবে চিং সরকারের পতন ঘটতে থাকে। ফেয়ারব্যাংক বলেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন, জাতীয় ঐক্য স্থাপন এবং অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পুনরুজ্জীবনের কাজগুলোকে সমাধান করতে চিং সরকার সর্মান্তিক শৈথিল্য ও দীর্ঘ সূত্রতা ছিল এই সরকারের পতনের কারণ এবং প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট।
প্রজাতান্ত্রিক ভাবধারার অনুপ্রবেশঃ
১৯০১ সালের পর জু-সির নির্দেশে যে বিলম্বিত সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হয়, ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল চিং সরকারের পতনের বীজ। ফেয়ারব্যাঙ্ক বলেছেন, “জবভড়ৎসং, হড়ঃ ঃযব জবাড়ষঁঃরড়হরংঃং, সধরহষু ঢ়ৎবঢ়ধৎবফ ঃযব মৎড়ঁহফ ভড়ৎ ঃযব ংবাড়ষঁঃরড়হ.”
বিলম্বিত চীন সংস্কারের যে প্রবল হাওয়া চীনে ঢোকান হয় তার সঙ্গে চিং বংশের ধ্বংশকারী বিপ্লবী মতবাদ এবং প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ জোরদার হয়। চীন থেকে যে ছাত্ররা বিদেশে পাঠান হয় তারা জাপান ও ইউরোপ থেকে সংবিধান , গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধি সভার আদর্শ চীনে বহন করে আনে। এমনকি চীনের নব সমর নায়কের মধ্যেও এই সংবিধানিক শাসনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবী, ছাত্র সাংবাদিক, বণিক সকলেই চীন রাজতন্ত্র বিরোধী মুক্তপন্থী, উদারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি তোলে। চীন সরকারের সংস্কারের ফলে যে প্রাদেশিক প্রতিনিধি সভাগুলো গঠিত হয়, তা ক্রমে কেন্দ্রীয় চিং সরকার বিরোধী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব নিলে কেন্দ্রীয় চিং সরকারের পতন সুচিত হয়।
শ্রমিক শ্রেণীর আত্মপ্রকাশঃ
পাশ্চাত্য শক্তির সহায়তায় চীনে রেলপথ এবং বিভিন্ন ধরণের শিল্প গড়ে উঠার ফলে চীনের শ্রমিক শ্রেণী নতুন একটি সামাজিক শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই শ্রমিকরা এসেছিল গ্রাম থেকে। অতীতে এরা কৃষি ক্ষেত্রে অথবা গ্রামীণ হস্তশিল্পের বিনাশের ফলে এই সমস্ত কর্মচ্যুত মানুষ শহরে এসেছিল শিল্প শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য। এসব শ্রমিক শ্রেণী গ্রামীণ সমাজের দুরবস্থা স¤পর্কে জানতেন। শহরের শিল্পাঞ্চলগুলোর প্রতিকুল প্ররিবেশ তাদের অবস্থা আরও দূর্বিসহ করে তুলেছিল। সুতরাং তারা যে কোন উপায়ে স্থিতিবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর এই আকাঙ্খা বিপ্লবী পরিস্থিতিকে জোরালো করেছিল।
প্রত্যক্ষ কারণঃ
(১)     সম্রাজ্ঞী জু-সির মৃত্যুর পর চিং সরকার যে সংকটে পড়ে তা থেকে তারা মুক্ত হতে পারত। যদি আগের মতই প্রাদেশিক স্তরে কনফুসীয় আদর্শে বিশ্বাসী জোরদার সমর্থন পেত। কিন্তু চীনে শিক্ষা বিস্তার এবং বাণিজ্য বিস্তারের ফলে বহু জেন্ট্রি কনফুসীয় দর্শনে পারদর্শিতা অর্জন করে সরকারী চাকুরী গ্রহণ অপেক্ষা স্বাধীন ব্যবসা-শিল্পকে বরণীয় মনে করে। এজন্য বিদ্বান জেন্ট্রিদের মধ্যে সম্রাটতন্ত্রেরপ্রতি আনুগত্য ও এবং কনফুসীয় মূল্যবোধ হ্রাস পায় সমাজে সমর্থন শ্রেণী লুপ্ত হতে থাকায় চিং শাসনের বিরোধী প্রজাতন্ত্রীরা প্রবল হয়।
(২)     আগে ভূমি মালিক জেন্ট্রিরা জলসেচ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, আঞ্চলিক শান্তিরক্ষা প্রভৃতি দায়িত্ব বহন করত। এখন তারা বাণিজ্যমুখী হলে এই প্রয়োজনীয় কাজগুলো অবহেলিত হয়, এজন্য চিং সরকার নিন্দিত হয়।
(৩)     চীনে জনসংখ্যার বিরাট বিস্ফোড়ন ঘটে। তাদের জীবিকা সংস্থানের জন্য চিং সরকার কোন উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকারী ভূমি করের অতিরিক্তি চাপ এবং রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের দূর্ণীতি কৃষকের জীবনকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। এর ফলে প্রজাতান্ত্রীদের ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্র“তি ড: সান ইয়াৎ সেনের সমাজতন্ত্রের আদর্শ তাদের মনে দোলা দেয়।
(৪)     চীন-জাপান যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এবং বক্সার বিদ্রোহের বিরাট ক্ষতিপূরণের বোঝা চিং সরকারের কাঁধে চাপলে, সরকার সাধারণ প্রজাদের উপর কর বৃদ্ধি করে এই অর্থ আদায়ের  চেষ্টা করায় দরিদ্র জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশার সীমা ছিল না। এভাবে গোটা চীন যখন বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মুখে এসে পড়ে। সেই সময় চিং সরকারর রেলপথ নির্মাতা নীতিকে কেন্দ্র করে ১৯১১ সালে প্রজাতন্ত্রী বিপ্লব হয়।
প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবঃ
উপরোক্ত কারণ গুলোর প্রেক্ষিতে গোটা চীন যখন বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মুখে পড়ে, সেই সময় চীন সরকারের রেল পথ রীতিকে উপলক্ষ করে ১৯১১ সালে প্রজাতন্ত্রী বিপ্লব শুরু হয়। চীনে বৈদেশিক সহায়তা বর্জন করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জোট বেঁধে কখনও প্রাদেশিক সরকারের সহায়তায় দেশীয় প্রচেষ্টায় রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু করে শেষ করতে ব্যর্থ হয়। এ সময় বিদেশী শক্তিগুলো নিজ নিজ প্রভাবাধীন এলাকায় অসমাপ্ত কাজ শেষ করে। অনেক রেলপথ অসমাপ্ত থেকে যায়। দেশীয় প্রচেষ্টায় কয়েকটি বিদেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শেষ করা হয়। এই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে রেলপথ জাতীয়করণের অজুহাতে চালু রেলপথগুলো এবং নতুন রেলপথ নির্মানের অধিকার বিদেশী কোম্পানীগুলোর হাতে তুলে দেন এতে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। সাধারণ লোক ও কৃষকরাও এই আন্দোলনের অংশীাদার হয়। ধর্মঘট ও স্কুল-কলেজ বন্ধ করে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়। সে-চুয়ান প্রদেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে সরকারী বাহিনী ধর্মঘটী জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করলে আন্দোলন সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। এ সময় উচাং ক্র সেনাদল বিপ্লবীদের পক্ষ নেয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল উচাং বিপ্লবীদের সমর্থনে আন্দোলন গড়ে উঠে। চীনজুড়ে বিভিন্ন প্রদেশ মাঞ্চু শাসনের কবল থেকে বিপ্লবীরা মুক্ত করতে থাকেন। এমতাবস্থায় মাঞ্চু সরকারের প্রতিনিধিরা নানকিং- এ মিলিত হয়ে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯১২ সালে ১ জানুয়ারি বিপ্লবীরা নানকিং- এ একটি সমান্তরাল সরকার গঠন  করেন। ড: সান ইয়াৎ সেন এই অস্থায়ী করকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
১৯১১ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য:
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সাম্রাজ্যবাদ যখন চীনের অর্থনীতির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং চীনা ভূ-খণ্ডে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার করেছেল, তখন চীনের মানুষ সাম্রাজ্যাবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চিং রাজবংশের এই দেশপ্রেমিক কার্যাবলী দমন করার জন্য সর্বশক্তি নেয়োগ করেছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল- সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা চিং রাজতন্ত্রের বিরোধীতার নামান্তর মাত্র। এই সমস্ত দেশপ্রেমিক অভ্যুত্থানগুলোই শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল। নিম্নে বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
(১)      ১৯১১ সালে চীনে র প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জনগণের মধ্যে জাতীয়তা বাদী চেতনা। জনগণের জাতীয়তাবাদী দাবির মধ্যেই চীনের নতুন সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর আশা-আকাঙ্খার এবং গ্রামীণ দরিদ্র-শ্রেণীর রিক্ততার সেই প্রতিফলন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক জ্যাঁ শ্যোনো বলেছেন, “ঈযরহবং হধঃরড়হধষরংস ফবাবষড়ঢ়বফ ড়ভ ঃযব নবমরহহরহম ড়ভ ঃযব পবহঃঁৎু ধহফ পবহঃৎবফ ড়হ ঃড়ি ঃযবধসং যধৎঃবফ ড়ভ সধহবযবব ফুহধংঃু ধহফ যড়ংঃরষরঃু ঃড়ধিৎফ রসঢ়বৎরধষরংস”
(২)     ১৯১১ সালের গনতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে পরিবর্তনবাদীদের মধ্যে স্পষ্ট মেরুকরণ ঘটেছিল। একদল ছিল লিয়াং চি-চাও এর সেতৃত্বে সংস্কারাদী আন্দোলনের সমর্থক এবং অন্যদল ছিল সান ইয়াৎ সেনের সেতৃত্বে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পাক্ষে। লিয়াং চি-চাও ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী ও সুপণ্ডিত। তিনি চীনে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পক্ষপাতী। অন্যদিকে সান এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণের স্বত:স্ফুর্ত বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মাঞ্চু রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।
(৩)     ১৯১৪ সালে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে সান ইয়াৎ সেন জনগণের তিনটি নীতি ঘোষণা করেন ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র। ঐতিহাসিক ইম্যানুয়েল  বলেন সান ইয়াৎ সেন একটির মধ্যে তিনটি বিপ্লব সংঘঠিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। একটি জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে প্রজাতন্ত্র গঠন করতে চেয়েছিলেন এবং একটি সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের জমি বণ্টনের উপর সাম্য প্রতিষ্ঠিত করে চীনে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের উত্থানের পথ রুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
(৪)     চীনের বিপ্লবে রাজতান্ত্রিক ব্যবহার উচ্ছেদ সাধন করেছিল। এমনকি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ছদ্মবেশেও চিং রাজতন্ত্রের ফিরে আসার রাস্তা বিপ্লবীরা খোলা রাখেননি।
(৫)     চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা ১৯১১ সালের বিপ্লবকে বুর্জোয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করলেও একই সাথে একথাও স্বীকার করেছেন যে, তৎকালীন চীনে বুর্জোয়া শ্রেণী একটি শক্তিশালী সামাজিক শ্যেনী হিসেবে গড়ে উঠেনি। তারা চীনের অর্থনৈতিক স্বধীনতা চেয়েছিলেন বটে। কিন্তু একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে তারা ব্যর্থ হল। চীনা ঐতিহাসিক উ.ইউ. ঝ্যাং মন্তব্য করেছেন, “ঞযব ১৯১১ জবাড়ষঁঃরড়হ পষবধৎষু ৎবাবধষবফ ঃযব বিধশ ধহফ পড়সঢ়ড়ৎড়সবংরহম পযধৎধপঃবৎ ড়ভ ঃযব পযরহবংব নড়ঁৎমবড়রংরব”
চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাৎপর্যঃ
(১)        চীনে প্রজাতন্ত্রের উত্থান দুইহাজার বছরেরও অধিককাল স্থায়ী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। প্রজাতান্ত্রিক চীনে আর কোন দেবপুরের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হয় না। উপরন্তু চীন পরিগণিত চীনা জাতীয় সম্পত্তিরূপে।
(২)       চীনে প্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠার ফলে চীনা বিপ্লবীদের সুদীর্ঘকালের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয়।
(৩)       দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা আর কেবলমাত্র মাঞ্চু উপজাতির কবলীজুত থাকে না। রাজনৈতিক ক্ষমতা একন সম্প্রসারিত হয় চীনে অধ্যুষিত সকল শ্রেণীর মধ্যে, যথা চীনা, মাঞ্চু মোঙ্গল, মুসলমান, এবং তিব্বতী।
(৪)       ১০ অক্টোবর, ১৯১১ সালে উচাং বিদ্রোহের পরে ১২ ফেব্র“য়ারি, ১৯১২ সালে সর্বশেষ চিং সম্রাট পদত্যাগ ঘোষণা করলে চীনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসন অবলুপ্ত হয়। এবং স্বল্প কালের ব্যবধানে প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য পৃথিবীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে গৃহীত হয়।
(৫)       চীনে মাঞ্চু শাসনের উচ্ছেদের পর সান ইয়াৎ সেনের সহকর্মীদের দ্বারা তার তিন নীতি জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র গ্রহণীয় হয়নি। তারা কেবল জাতীয়তাবাদ নীতিকে অনুসরণ করে। ফলে সান ইয়াৎ সেনের স্বপ্নে দেখা চীন স্বপ্নরাজ্যেই থেকে যায়। বাস্তবে রূপ পায় না।
(৬)       গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিক ১৯১১ সালের বিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এই সাথে একথাও স্বীকার করেছেন যে তৎকালীন চীনে বুর্জোয়া শ্রেণী একটি শক্তিশালী সামাজিক শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠেনি। তারা চীনের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা চেয়েছিলেন বটে কিন্তু প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব কিনাঃ
প্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা বৈপ্লবিক আন্দোলন ও পরিবর্তনের ফরশ্র“তি। ইতিহাসের বিশ্লেষকদের মতে প্রকৃতপক্ষে ১৮৮০ সালে আফিমের যুদ্ধে চীনের বিপ্লবের সুত্রপাত ঘটে। ১০৯ বছর পর ১৯৪৯ সালে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার সেই বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটে। বিশ্লেষকগণ চীনের বিপ্লবসমূহকে দুটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে তথা ১৮৪০ থেকে ১৯১১ সালের ৪ মের আন্দোলন পর্যন্ত প্রায় ৮০ বছরের বিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। এই দীর্ঘ সময় বিদেশী পুঁজিবাদ প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তপ্রভু ইত্যাদির বিরুদ্ধে চীনের জনগণ আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যা। এ সংগ্রামের শেষ পর্বে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন চীনের মহান জাতীয়বাদী নেতা সান ইয়াৎ সেন। তাছাড়া সমসাময়িক বিশ্বের ঘটনাবলী চীনাদের নিজ দেশে একটি পরিবর্তনের আশা জাগ্রত করে তোলে। এসব বাস্তব ফলশ্র“তি চীনের বিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে নানকিং এ একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের মাধ্যমে চীনে সর্বপ্রথম বুর্জোয়া প্রজাতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
১৯১১ সালের বিপ্লবে সান ইয়াৎ সেনের ভূমিকাঃ
১৯১১ সালের ইয়াৎ সেনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ১৮৬৬ সালে দক্ষিণ চীনে ইয়াৎ সেনের জন্ম। পিতৃব্য তাইপিং বিদ্রোহে যোগদান করেন। তার প্রভাবে সান বাল্যকাল থেকেই তাইপিং নেতা ইংসিউ চুয়ানকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করায় তার মনে স্বদেশের প্রতি ভালবাসা বাল্যকাল থেকে উপ্ত হয়। ১৮৮৫ সালে ফ্রান্সের সাথে সংঘর্ষে চীনের পরাজায় থেকেই চীনের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তিনি তৎকালীন অন্যতম প্রধান নেতা লিং হুং চ্যাং  নিকট চীনা সংস্কারের প্রস্তাব সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। কিন্তু তার কোন উত্তর পাননি। এভাবে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অজ্ঞাত হয়ে নতুন পথ অবলম্বন করেন। যে পথ বণিকের জন্য নয়, কৃষকের জন্য নয়, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত জনের জন্য নয় অথবা চিকিৎসকের জন্য নয় উপরন্তু সে পথ বিপ্লবীর পথ যে পথের পথিক বিশেষ কোন শ্রেণীর সেবার জন্য নিদ্দিষ্ট হন না বরং সর্বশ্রেণীর জনগণের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে স্বদেশ সেবায় নিয়োজিত হন। সান ইয়াৎ সেন মূলত ছিলেন একজন বিপ্লবী, ১৮৯৪ সালে তিনি “জবারাব ঈযরহধ ঝড়পরবঃু” নামে ১১২ জন সভ্য সম্বলিত একটি সমিতি গঠন করেন। এর একটি শাখা উদ্বোধন করেন ঝড়হর ঞড়ংযর এবং মিয়াজাকি ভ্রাতৃদ্বয়- ণধুধ এবং ঞড়ৎধ তড় চীনা বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। ১ অক্টোবর ১৮৯৬ সাল থেকে সান ইয়াৎ সেন ইউরোপে অতিবাহিত করেন এবং শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা, ধর্মঘট মালিক-শ্রমিক সংঘর্ষ কিভাবে ইউরোপের শান্তি শৃঙ্খলা বিঘিœত করছে। এ থেকে তিনি উপলব্ধি করেন যে, সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশের সমৃদ্ধি কেন্দ্রীভূত না থাকে অর্থাৎ পুঁজিবাদ যাতে মাথা তুলতে না পারে তার জন্যে পূর্ব থেকে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণে অগ্রসর হন। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে চীনে বিপ্লব ঘটাবার জন্য বেশ কিছু গোষ্ঠী কার্যকরী ছিল সান উপলব্ধি করেন যে এই সকল গোষ্ঠীগুলিকে একত্র করতে না পারলে বিপ্লবের প্রাণশক্তি পাওয়া যাবেনা। বিপ্লব  করে কিভাবে চীনকে গড়ে তুলতে হবে তার সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণা করেন।
(ক) জাতীয়তাবাদ (খ) গণতন্ত্র (গ) জনগণের জীবিকা
১৯০২-০৫ সালের মধ্যে তিনি তার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সহযোগীতা কামনা করেন ভিয়েতনাম, হনলুলু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান পরিদর্শন করেন এবং একটি বিপ্লবী আন্দোলনে বদ্ধপরিকর হন। ১৯০৫ সালে তিনি ব্রাসেলস্, বার্লিন, প্যারিসে চীনা ছাত্রদের নিয়ে তিনটি বিপ্লবী দল গঠন করেন এবং জাপানে এসে সকল বিপ্লবী দলকে সংগঠিত করেন। যার নামকরণ করেন “ঈযরহবংব টহরঃবফ ষবধমঁব” এবং তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এ দলের উদ্যোগেই ১৯১১ সালে গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল। অধ্যাপক জ্যাঁ শ্যেনো বলেছেন, “ঈটখ জবঢ়ৎবংবহঃবফ ফবভরহরঃব ঢ়ৎবমৎবংং রহ ঃযব ঁহরভরপধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু গড়াবসবহঃ ধহফ ঃযব ভড়ৎসধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ওফবড়ষড়মু”. ঈটখ এর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ছাত্র সমাজ, পণ্ডিত সমাজ ও প্রগতিশীল সামরিক অফিসার সকলেই সানকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। ১২ ফেব্র“য়ারি ১৯১২ চীন সরকার পদত্যাগ করলে রাজতন্ত্রর অবসান হয় এবং প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।
ড: সান ইয়াৎ সেনকে চীনা প্রজাতন্ত্রের জনক বলা যায় কিনাঃ
ড: সান ইয়াৎ সেনকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আধুনিক চীনের জনক হিসেবে অবহিত করেন। কেননা একদিকে যেমন চীনে বিদেশিদের আধিপত্যের অবসান করতে চেয়েছিলেন অন্য দিকে তেমনি মাঞ্চু সরকারের অপশাসনকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। এভাবে তিনি চীন দেশ থেকে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে এ দেশে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যাতে আপামর জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। এ কাজ সহজসাধ্য ছিলনা। কারণ তার বিরোধী হিসেবে ছিল প্রথমত মাঞ্চু করকার ও দ্বিতীয়ত বিদেশী স্বার্থবাদী শক্তি। ফলে  এদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে গিয়ে তিনি নির্যাতিত, কারারুদ্ধ ও নির্বাসিত হয়েছেন। তিনি দীর্ঘ সময় বিদেশে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। অবশেষে বিপ্লবী সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে সান এর নেতৃত্বে চীনের রাজতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন। এসব কারণে কমিউনিষ্ট পন্থী সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ড: সান ইয়াৎ সেনকে চীনা প্রজাতন্ত্রের জনক বলে অভিহিত করেন।
উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শাতব্দীর গোড়ার দিকে চীনে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দৌরাত্ম অপরদিকে মাঞ্চু সরকারের অপশাসনের ফলে দেশটি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। এ সমস্যাসঙ্কুল অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য চীনের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগণ ১৯১১ সালে দেশটিতে একটি সফল বিপ্লব সংঘটিত করে সেটি প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে চীনের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান হয় এবং প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। এ আন্দোলনে পুরোধা ছিলেন সান ইয়াৎ সেন। জন ফেয়ারব্যাঙ্ক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “চীনের মহান বিপ্লবী নেতা ড: সান ইয়াৎ সেন এর বিশিষ্ট ভূমিকা চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য রাজপথ উম্মুক্ত করে।”

3 মন্তব্য(গুলি):

  1. Unknown বলেছেন...

    cine kivabe sorkar gothito hoy?se somporke ektu likhben.pls

    ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ এ ৫:০০ AM  

  2. Unknown বলেছেন...

    nice

    ১৮ জানুয়ারী, ২০২০ এ ১:১৩ AM  

  3. Manas Roy বলেছেন...

    তথ্যবহুল লেখা

    ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ এ ৮:২৮ PM  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন