ভূমিকা
চীনের ১৮৯৮ সালের সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই (১৮৯৯-১৯০১) চীন এক ব্যাপক গণবিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল। এই গন অভ্যুত্থানই চীনের ইতিহাসে বিখ্যাত বক্সার বিদ্রোহ নামে পরিচিত। প্রথম চীন জাপান যুদ্ধের পর যখন বিদেশী শক্তিগুলো স্ব-স্ব স্বার্থে চীনের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করতে তৎপর হন, তখন বিদেশীদেরকে দেশ থেকে অপসারনের জন্য এবং দেশকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদিতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য বক্সার নামে একটি গুপ্ত সমিতি উনবিংশ শতকের অন্তিমলগ্নে এবং বিশ শতাব্দির প্রারম্ভিক পর্বে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। চীনে এই বিদ্রোহ আই-হো- চুয়ান নামে পরিচিত। বিদেশীরা এই বিদ্রোহকে “বক্সার বিদ্রোহ” নামে আখ্যায়িত করে ছিল।
বক্সার বিদ্রোহের উৎপত্তি
বক্সার সমিতি ছিল অষ্টাদশ শতকের অষ্টত্রিগ্রাম সমিতির প্রশাখা। বক্সার সমিতির মূল নাম ছিল আই-হো-চোয়ান বা মুষ্টি যোদ্ধাদের ন্যয়ভিত্তিক ভ্রাতৃসংঘ। আই-হো অর্থ ন্যায়পরায়নতা এবং চুয়ান শব্দের অর্থ মুষ্টিযুদ্ধ। এই সমিতির সদস্যরা দেহ ও মনের সঙ্গে সমন্ময় সাধনের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করতেন।
চিয়া চিং যুগে (১৭৯৬-১৮২০) অষ্টত্রিগ্রাম সমিতি নামে গুপ্তসমিতির মধ্যেই বক্সারদের উৎপত্তি হয়েছিল। এই ট্রায়াগ্রাম সেন্ট পাকুয়া নামে পরিচিত ছিল। পা-কুয়া চিও “হোয়াইট লোটস সোসাইটি” নামে একটি মাঞ্চু বিরোধী গুপ্তসমিতির সাথে যুক্ত। পাকুয়া চিও এর ভেতরে আই হো চোয়ান নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠেছিল। বহু বছর পরে বিদেশীরা আই হো চোয়ানের সদস্যদের বক্সার নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথম দিকে এই সমিতি ছিল মাঞ্চু রাজবংশ বিরোধী। ১৮৯০ এর দশকের আই-হো-চুয়ান সদস্যরা মাঞ্চু রাজবংশ বিরোধীতার পরিবর্তে উগ্র বিদেশ বিরোধী হয়ে ওঠে।
তারা বিদেশীদের ও তাদের চীনা সহযোগীদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সময়ে আই-হো-চুয়ানের কার্যকলাপকে শানটুং এর রক্ষণশীল গর্ভনর লি-পেং-হো যথেষ্ট মদত দিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী গর্ভনর ইউ-শিয়েনও তাদের উগ্র সমর্থক ছিলেন। আই-হো চুয়ানের কথাটির অর্থ ছিল ন্যায়পরায়ন ও সমন্বয়পূর্ণ স্থানীয় বাহিনী।
এই সমিতির সদস্যরা দেহ ও মনের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করতেন। অধিকন্তু তাঁরা একপ্রকার যাদুকরী বিদ্যা আয়ত্ত করে ধর্মগত আচার পালন করতেন। প্রয়োজনীয় কোন মন্ত্র তাঁরা তিনবার উচ্চারণ করতেন,মুখে ফেনা উঠাতেন এবং দাঁত দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এইসব প্রক্রিয়ার ফলে তাঁদের মধ্যে এক অতি প্রাকৃত শক্তি সঞ্চিত হতো। ফলে শত্র“দের গোলাগুলি নাকি তাঁদের দেহ ভেদ করতে পারতো না। বক্সারদের রীতি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে এক টুকরো হলুদ বর্ণের কাগজ যাতে অঙ্কিত থাকত একটি পদহীন মানুষ্য মূর্তি দগ্ধ করা এবং দগ্ধ করাকালীন কিছু যাদু মন্ত্র অনুচ্ছাস্বরে উচ্চারণ করা। ফলে আবির্ভূত হতো স্বর্গীয় সেনাদল ও সেনাপতিবৃন্দ যা যুদ্ধে জয়লাভ করতে সহায়তা করত। বিদেশীদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষনের দরুন বক্সারগন বন্দুক ব্যবহার না করে প্রাচীন ধরনের তরবারি ও বর্শা ব্যবহার করতেন। এর ফলে আন্দোলন করীদের মধ্যে প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টাই প্রতিফলিত হয়েছে।
বক্সার বিদ্রোহের কারণ ঃ
বৈদেশিক শক্তির উচ্ছেদ সাধন, খৃষ্টধর্ম প্রচারে বাধা দান এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ভিত্তিক সংস্কার প্রবর্তনে বিরোধীতা এই তিনটি উদ্দেশ্য সম্মুখে বলে বক্সার সমিতি ১৯০০ সালে যে বিদ্রোহ ঘোষনা করে তার পাশ্চাতে বিদ্যমান ছিল একাধিক কারণ, নিন্মে তা প্রদত্ত হল।
খ্রীষ্টধর্মের প্রতি বিদ্ধেষ
কনফুসীয় মতবাদ, তাওবাদ এবং বৌদ্ধধর্মের দ্বারা অনুপ্রানীত চীনারা খ্রীষ্টধর্মের অনুপ্রবেশ কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। খ্রীষ্টান মিশনারীরা চীনে যখন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তখন চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই এটিকে তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করেছিলেন। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে তিয়েন্তসিনের চুক্তির মাধ্যমে খ্রীষ্টান মিশনারীরা চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছিলেন, এবং ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে কনভেনশন অফ পিকিং এর মাধ্যমে তাঁরা চীনে জমি কেনা-বেচার অধিকার লাভ করেছিলেন।
চীনের জনসাধারণ এবং খ্রীস্টান মিশনারীদের মধ্যে ১৮৬০ এর দশক থেকেই তিক্ত সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল। তবে ১৮৯০ এর দশকে এই তিক্ততা সংঘর্ষে রুপান্তরিত হয়। ১৮৯৫ সালে গুজব রটে যে, বিদেশীরা খুব শীঘ্রই সি চুয়ান আক্রমণ করবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে চেং ডু এবং তার পাশ্ববর্তী জেলা গুলিতে প্রবল হিংসাতœক ঘটনা ঘটতে থাকে। আগস্ট মাসে শ্বেতপদ্ম সমিতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নিরামিষাশী গোষ্ঠীর সদস্যরা ফুজিয়ানের অন্তর্ভুক্ত গুচিয়ান শহরে প্রচুর খ্রীস্টান গির্জা অগ্নিদগ্ধ করেন এবং ৯ জন খ্রীষ্টান মিশনারীকে হত্যা করেন। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ ধরে হুনান , হুসবোই, চিয়াংশু, চিশুয়াং, শানটুং প্রভৃতি অঞ্চলে অনুরুপ বহু ঘটনা ঘটে। শান্টুং অঞ্চলে দুই জন মিশনারী নিহত হলে জার্মানী উক্ত ঘটনাকে সামরিক অভিযান চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে। এর পরেই পশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ চীনকে নিজেদের “প্রভাবাধীন অঞ্চল” এ ভাগ করে নেয়।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনরোষ ঃ
১৮৯৭ -৯৮ সাল নাগাদ বিদেশী শক্তিবর্গ যখন চীনকে নিজেদের “প্রভাবাধীন অঞ্চলে ভাগ করে নেয়” তখন চীনারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বাধীনতা লুপ্তির আশঙ্কায় আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন। চীনের সংস্কার আন্দোলনের নেতা কাং ইউ ওয়েই ১৮৯৮ এর ১৭ই এপ্রিল জাতীয় সুরক্ষা সমিতির সদস্যদের সামনে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে বিদেশী অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে চীন অচিরেই বর্মা, আন্নাম, ভারতবর্ষ বা পোল্যান্ডের মতো একটি পরাধীন দেশে পরিণত হবে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকেই বিদেশীদের হত্যা করতে আরম্ভ করেন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি
বক্সার আন্দোলন শুরুর পূর্ব থেকেই চীনের ব্যবসায়ের বাজারে মন্দা দেখা দেয়। অহিফেন যুদ্ধোত্তর বৎসরগুলিতে ক্রমঃবর্ধমান বিদেশী পন্য আমদানি চীনের অর্থনীতির উপর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে ইয়েলো নদীর বন্যার ফলে শানটুং প্রদেশে খাদ্যাভাব ঘটে এবং জনগণ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। উত্তর চীনে খাবার জন্য ফসলের ফলন আশাপ্রদ হয় না। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যের সন্ধান নানা দুঃখ-কষ্ট বরণ করে বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়। চীনে বিদেশী তুলাজাত বস্ত্রাদী ও বিদেশী তৈল আমদানি হওয়ায় স্থানীয় তুলা ও তৈল ব্যবসায়ীদিগকে ক্রয় বিক্রয়ের বাজারে মন্দার সম্মুখীন হতে হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা সূতিবস্ত্রের মূল্য চীনে প্রস্তুত সূতিবস্ত্রের মূল্য যথেষ্ট কম হওয়ায় বাজারে দেশী সূতি বস্ত্রের বিক্রয় হ্রাস পায়। ফলে বহু চীনা তাঁতির জীবিকা উপার্জন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। আবার নতুন রেলপথ নির্মানের প্রস্তাব পশুবাহিত এবং হস্তচালিত শকটের মালিকেরা এবং তরী ও বজরার মালিকগণ উপার্জন হ্রাসের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়। তাইপিং বিপ্লবের পূর্বে চীনে যে অর্থনৈতিক অবনতি পরিলক্ষিত হয় তা বিপ্লবোত্তর বছর গুলোতেও বিদ্যমান থাকে। ১৮৯৯ সালে চীনের ব্যবসায়ে ঘাটতির মূল্য দাড়ায় ৬৯ মিলিয়ন টিল। এইভাবে উনবিংশ শতকে শেষার্ধে চীনের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটে । অর্থনীতিক দুরবস্থার জন্য বক্সার সমিতি চীনের উপর বৈদেশিক প্রভাবকে দায়ী করে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি সংকট
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি চীনে কৃষি সংকট বাড়িয়ে তুলেছিল। আলবার্ট ফুয়েরওয়ার্কারের “ঞযব ঈযরহবংব ঊপড়হড়সু” (১৮৭০-১৯১১)নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭৩ থেকে ১৮৯৩ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৮ শতাংশ,অথচ একই সময়ে চীনে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কৃষিজমির পরিমান বৃদ্ধি অত্যন্ত নগণ্য। ফলে জমিতে ভিড় উপচে পড়ে এবং চাষীদের কৃষিজমির মাপ ক্রমশ ছোট হতে থাকে। তৎকালীন চীনে কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ ছিল অত্যন্ত সামান্য। ফলে উন্নতমানের সার, বীজ বা প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল না । ভাড়াটে চাষীদের উৎপাদনের অর্ধেক বা কোন কোন ক্ষেত্রে আট দশমাংশ পর্যন্ত কর দিতে হত। এতে একজন ভাড়াটে চাষীর পক্ষে তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ করা অতি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা তখন মহাজনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হতেন এবং ঋণভারে জর্জরিত হতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের ভূমিচ্যুত করা হত। ১৮৯৮ সাল নাগাদ ভূমিহীন চাষী,ভবঘুরে এবং ভিখারীর সংখ্যা চীনে বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এরাই পরবর্তী কালে বক্সার বিদ্রোহে যোগদান করেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটকে ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ । ১৮৫২ সালে ইয়েলো নদী হুনান থেকে শানটুং এর দিকে গতি পরিবর্তন করে। ১৮৮২সালের পর থেকে শানটুং অঞ্চলে মাঝে মাঝে বন্যা হতে থাকে। ১৮৯৮সালে এক বিধ্বংসী বন্যার ফলে শানটুং এর প্রায় শতাধিক গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সে চুয়ান,কিয়াংসি, কিয়াসু,আনহয়েই প্রভৃতি অঞ্চল ও অনুরুপ বিধ্বংসী বন্যার শিকার হয়। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর চীনে মারাতœক খরা দেখা দেয়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে চীনের জনসাধারনের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় চীনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পন্ডিতেরা ও রাজপুরুষেরা প্রচার করতে থাকেন যে, বিদেশী ও খৃষ্টধর্মের কুপ্রভাবের ফলেই চীন নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দ্ধারা আক্রান্ত হয়েছে। ফলে চীনের সাধারন মানুষের বিদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্ধেষ পূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সামাজিক অসন্তোষ
তখন সম্রাট কুয়াং সুর নেতৃত্বে এবং তাঁর প্রধান উপদেষ্টা কাং ইউ ওয়েই এর সহযোগিতায় চীন সমাজ কে পাশ্চাত্য ধাঁচে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলে। বক্সার আন্দোলনের পূর্বে চীনের দক্ষিণ এবং মধ্য অঞ্চলে ণড়ঁহম ঈযরহধ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল চীনকে পশ্চিমী সভ্যতায় দীক্ষিত করা। সম্রাট কয়াং সু ও দেশে পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রাসারের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতাকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি অনেকগুলো রাজাজ্ঞা প্রচার করেন। বক্সার সমিতির মতে এই ভাবে পশ্চিমা ধাঁচে সমাজ পুর্নগঠনের চেষ্টা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়, যেহেতু এরূপ প্রচেষ্টা ঐতিহ্যমন্ডিত চীনা সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করার সমতুল্য। এরূপ পরিস্থিতি বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
বক্সার বিদ্রোহোর প্রসার
বক্সার বিদ্রোহের ইতিহাসে ১৮৯৯ সাল একটি স্মরণীয় বৎসর। ঐ বৎসরেই বক্সারগন সমগ্র দেশব্যাপী বিদেশী বিতাড়নের আন্দোলন শুরু করে। প্রথম অবস্থায় আন্দোলন আতœপ্রকাশ করে প্রদেশ গুলোতে । প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আন্দোলন বেশি জোরদার হয় শানটুং প্রদেশে। ২৮মে ১৯০০সাল পিকিং এ বিদেশীদের বিতাড়নের জন্য কুটনীতিবিদদের সতর্ককরা হয়। ১৩জুন বিদ্রোহিরা পিকিং এ অবস্থিত গীর্জা ও সাধারণ বিদেশীদের বাসস্থান অগ্নিদগ্ধ করে, ধর্মান্তরিত চীনা খ্রীস্টানদিগকে হত্যা করে অথবা জীবন্ত অবস্থায় কবরে সমাহিত করে। ১৪জুন ১৯০০ সাল বক্সার বিদ্রোহীগন বিদেশী দূতাবাসের প্রহরীদের উপর আক্রমণ চালায়। ২০জুন পিকিং এ নিযুক্ত জার্মান মন্ত্রি ঈষবসবহং ঠড়হ কবঃঃষবৎ কে হত্যা করে। পিকিং এর ন্যায় তিয়েনসিনেও বিদ্রোহিরা হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৬জুন সম্রাজ্ঞী জু’ সী একটি সভা আহ্বান করে। ১৯জুন ওসঢ়বৎরধষ ঈড়ঁহপরষএ সিদ্ধান্ত হয় যে বিদেশীদের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বক্সারদের সহায্যে বিদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করা হবে।
বিদেশীদের সাথে যুদ্ধ
বিদেশীদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে মাঞ্চু দরবার প্রাদেশিক শাসনকর্তাদিগকে আদেশ দেন, তাঁরা যেন বক্সারদের সংগঠিত করেন। ফলে প্রিন্স চুয়াং এবং কাং-ই ত্রিশ হাজার বক্সারদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আর প্রিন্স তুয়ান অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন ১৪০০ বক্সার দলের । এক একটি দল গঠিত হয় ১০০ থেকে ৩০০ বক্সার নিয়ে। জেনারেল তুং খফুসিয়াং এর অধীনে সরকারী সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে বক্সারগণ দূতাবাসের উপর আক্রমণ শুরু করে ২১ শে জুন। দূতাবাস অবরুদ্ধ হয়। দূতাবাসে তখন ৪৫০ জন রক্ষী, ১২জন বৈদেশীক মন্ত্রী সমেত ৪৭৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি, ২৩০০ চীনা খ্রীস্টান এবং প্রায় ৫০ জন ভৃত্য অবস্থান করছিল। আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রচন্ড বাধা দান করেন। বিদেশী মিত্র শক্তিবর্গ তখন আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠন করে পিকিং এর দূতাবাসের অবরোধ অবসানে উদ্যোগী হন। বিদেশী সেনাবাহিনী ১৪ জুলাই টিয়েন্টসিন দখল করে এবং ৪আগষ্ট পিকিং অভিমুখে যাত্রা করে। এই আন্তর্জাতিক বৈদেশিক বাহিনীতে মোট ছিল কিঞ্চি দুর্ধ ১৮হাজার সৈন্য। তন্মধ্যে ৮০০০ জাপানী সৈন্য, ৪৮০০ রুশ সৈন্য, ৩০০০ বৃটিশ সৈন্য, ২১০০ মার্কিন সৈন্য, ৮০০ ফরাসী সৈন্য, ৫৮ অস্ট্রিযার সৈন্য,৫৩ ইতালীয় সৈন্য। বিলম্বে জার্মান সৈন্য আস্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান করেন। টিয়েন্টসিন পিকিং পথ ধরে আন্তর্জাতিক বাহিনী পিকিং এ উপস্থিত হয় এবং বক্সার বাহিনীকে সম্পূর্ন রূপে পরাজিত করে ১৪ আগষ্ট দূতাবাসের অবরোধের অবসান ঘটায়।
বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি ঃ
ঐতিহাসিক জী শ্যেনো বলেছেন, বক্সার অভ্যূত্থান ছিল চীনাদের একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া এবং খ্রীস্টান মিশনারী ও ধর্মান্তরিত চীনা খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তিনি আরো বলেছেন,এটি ছিল গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক বিদ্রোহ। বিদ্রোহীদের প্রায় ৭০শতাংশ এসেছিল কৃষক পরিবার থেকে। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন ক্ষেতমজুর এবং এঁদের বয়স ছিল অত্যন্ত কম (সাধারনত ১২-১৮বছর বয়সের মধ্যে)। তাছাড়া, নৌকার মাঝি, ফেরিওয়ালা, কুলি, কর্মচ্যুত হস্তশিল্পী, ছোট দোকানদার, স্কুলশিক্ষক প্রভৃতিও এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করেন।
হৃ বিদ্রোহীদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র শ্রেণীর লোক। তবে পিকিং এর রাজসভা যখন থেকে বক্সারদের সমর্থন করতে থাকে,তখন প্রচুর রাজপুরুষ এবং জেন্ট্রির সদস্যরা বক্সারদের মদত দিয়েছিল।
হৃ বক্সার গণ-অভ্যুত্থানের নারীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁরা কতগুলি বিশেষ সংগঠনে বিভক্ত ছিলেন। ১২-১৮ বছর বয়সী মেয়েরা লাল লন্ঠন বাহিনীর সদস্য ছিলেন। নীল লন্ঠন বাহিনীর সদস্যা ছিলেন মাঝবয়সী গৃহবধুরা।
হৃ খ্রীস্টধর্মের বিরোধিতা এবং বিদেশী বিরোধিতা ছিল বক্সার বিদ্রোহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রথমদিকে অবশ্য এই বিদ্রোহ ছিল একই সাথে চিং রাজবংশ বিরোধী এবং বিদেশী বিরোধী। তখন বিদ্রোহিদের স্লোগান ছিল – “চিং বংশকে উৎপাটিত কর এবং বিদেশীদের খতম কর।
হৃ প্রকৃতপক্ষে বক্সার বিদ্রোহীদের কোন উন্নতমানের সামাজিক কর্মসূচী ছিল না। একটি বিদ্রোহকে সফল করার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন সে ধরনের কোন দক্ষ সংগঠনও বক্সারদের ছিল না।
হৃ চীনের ভূস্বামী শ্রেণী এবং একদল রাজপুরুষ বক্সার বিদ্রোহের সমর্থন করেছিলেন। কারণ, তাঁদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী ছিল পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল ভাবধারার পরিপন্থী। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বহু বছর পর বক্সার বিদ্রোহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বক্সার বিদ্রোহ ছিল একটি স্বতঃস্ফুর্ত কৃষক বিদ্রোহ।
বক্সার প্রোটকলঃ
বিদ্রোহ দমনের পর চীনকে খন্ডিত বিখন্ডিত করবার এমন সূবণ সুযোগ বিদেশী শক্তিবর্গ পূর্বে কখনও পাননি। তথাপি তাঁরা চীনের সার্বভৌমিকতা ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখতে সম্মত হন। চীনের পরাজয় এবং বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর বিদেশী শক্তিসমুহ চীনকে ১২ টি শর্ত সম্বলিত একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয় ১৯০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর । ১৯০১ সালে ৭ডিসেম্বর চীন এবং ১১টি বিদেশী শক্তির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তি “বক্সার প্রোটকল” নামে বিখ্যাত। চুক্তির শর্ত গুলো চীনের পক্ষে যথেষ্ট অপমান জনক। অথচ চীনের পক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষর না করে কোন উপায় ছিল না। শর্তগুলো ছিল নিম্ন রুপ ঃ
প্রথমত, ১২জন রাজপুরুষ যাঁরা বক্সারদের বিদেশ বিরোধী আন্দোলন যোগদান করেছিলেন তাঁদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় অথবা আতœহত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তা ছাড়া আরও শ’খানেক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। যে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রেই এটি ছিল একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত।
দ্বিতীয়ত, চীনকে এক বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দানে বাধ্য করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, চীনকে ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ক্ষতিপূরণ ১৯০১ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে বিভিন্ন কিস্তিতে দিতে হবে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ছাড়াও ইটালি,নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, স্পেন , পর্তুগাল এবং স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশগুলোও চীন থেকে প্রাপ্ত ক্ষতি পূরণের অংশীদার হবে। তৃতীয়ত,যেসব শহরে বিদেশী বিরোধী আন্দোলন তীব্র রুপ নিয়েছিল সে সব অঞ্চলে সরকারী পরীক্ষা ব্যবস্থা ৫ বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। কমপক্ষে ৪৫ টি শহরে পরীক্ষা ব্যবস্থা বাতিল হয়।
চতুর্থত, পিকিং এর বিদেশী দূতাবাসগুলিকে পাহারা দেবার জন্য বিদেশী সৈন্য বাহিনী স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হল।
পঞ্চমত, পিকিং থেকে সমুদ্র পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলিতে এবং রেলপথে বিদেশী সৈণ্য মোতায়েন করা হল।
ষষ্ঠত, সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে চীন বিদেশ থেকে কোন অস্ত্র বা যুদ্ধসামগ্রী আমদানী করতে পারবে না।
সপ্তমত, জার্মানী ও জাপানের কাছে চীনকে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সরাসরি কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
বক্সার প্রোটকলের সমালোচনা
১. বক্সার প্রোটকল চীনের সার্বভৌমিকতা ক্ষুন্ন করে। বিদেশ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ করণ, টাকু এবং অন্যান্য দূর্গের ধ্বংস সাধন, দূতাবাস গুলিতে এবং পিকিং থেকে সমুদ্রোপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিদেশী সৈন্য মোতায়েন রাখার অনুমতি দান, এসমস্তই চীনের সার্বভৌমিকতা ক্ষুন্ন করে।
২. চীনে বিদেশী কুটনীতিকদের সংগঠন চীনা সম্রাটের মর্যাদার হানিকর হয়।
৩. বক্সার বিদ্রোহকালে বিদ্রোহীদের নৃশংসতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের ভাবমূর্তি অনেকাংশে বিনষ্ট করে।
৪. চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত করা হয় ।
বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণ ঃ
১. বক্সার বিদ্রোহিদের কোন উন্নত মানের সামাজিক কর্মসূচি ছিল না। একটি বিদ্রোহ সফল করার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োাজন ছিল তা বক্সারদের ছিল না।
২. বক্সার বিদ্রোহীদের মতাদর্শগত ত্র“টি ছিল। তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে।
৩. তাদের কোন উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র ছিল না। বক্সার দের অস্ত্রের মধ্যে ছিল তীর,ধনুক ইত্যাদি। তারা যুদ্ধ করেছিল মধ্যযুগীয় অস্ত্র দিয়ে , অপরদিকে বিদেশীরা আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে।
৪. চীনা রাজদরবার থেকে বিদ্রোহীদের যখন সমর্থন দেয়া হয় তখন বিদ্রোহীরা নিজেদের শক্তির চেয়ে রাজদরবারের সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর শীল হয়ে পড়ে । এতে নিজেদের ভিতরে অনুশীলনের অভাব দেখা দেয়। রাজদরবারের সমর্থন বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ।
বক্সার বিদ্রোহের মূল্যায়ন ঃ
১. বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঊৎরপ ঐড়নংনধসি তাঁর ঢ়ৎরসরঃরাব জবনবষং নামক গ্রন্থে বলেছেন, বক্সার বিদ্রোহ ছিল সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিবাদের আদিম অভিব্যক্তি।
২. রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন বলেছেন, তাইপিং বিদ্রোহের মত বক্সার বিদ্রোহও ছিল একটি কৃষক আন্দোলন।
৩. প্রখ্যাত আমেরিকান উপন্যাসিক মার্ক টোয়েন “সভ্যতার তথাকথিত রক্ষক ” নামক গ্রন্থে বক্সার বিদ্রোহীদের উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন।
৪. গনপ্রজাতন্ত্রি চীনের ঐতিহাসিকরা বক্সার বিদ্রোহকে দেশপ্রেমিক চীনাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সর্বশেষ বলা যায় যে, বক্সার বিদ্রোহ ছিল বৈদেশিক শক্তির উচ্ছেদ সাধন এবং চীনা প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি সংগ্রাম।
কি বিদ্রোহ বক্সার বিদ্রোহ না বিপ্লব ?
বিপ্লব ও বিদ্রোহ শব্দ দুটিতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোন দেশের সামাজিক,রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক তথা প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশের জনগনের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণে যে আন্দোলন শুরু হয় এবং যা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো গঠিত হয় অর্থ্যাৎ প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে। যেমন ঃ- ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লব। অপর পক্ষে যে আন্দোলন উক্ত পরিবর্তন গুলো করতে সক্ষম হয় না তাকে বিদ্রোহ বলি। যেমন ঃ- ১৮৫৭সালের ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ।
বক্সার বিদ্রোহ ছিল একটি বিদেশ বিরোধী বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। এখানে চীনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় নি। অধিকন্তু এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে বক্সার বিদ্রোহ ছিল চিনা জনগনের বিদ্রোহ, বিপ্লব নয়।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে তবুও বক্সার বিদ্রোহের মাধ্যমে চীনের জনগণের দেশপ্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। এই বিদ্রোহের ফলে চীনা জনগণের মধ্যে নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবধারা ধরে রখার যে মনোভাব পরিলক্ষিত হয় তা সত্যি বিস্ময়কর। এই আন্দোলনের প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় যখন এই আন্দোলন বিংশ শতকে পৃথিবীব্যপী আধুনিক উপনিবেশিকতার বিরোধী হিসাবে বিবেচিত হয়। এই বিদ্রোহের পর মাঞ্চু সরকারের দূর্বলতা দেশে মাঞ্চুবিরোধী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। মাঞ্চুবিরোধী আন্দোলনের রুপকার ডঃ সুন ইয়ৎ-সেন এর নেতৃত্বে চীনে ১৯১১ সালে যে বুর্জোয়া গনতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয় তা ছিল এই বক্সার আন্দোলনের পরোক্ষ ফসল।
চীনের ১৮৯৮ সালের সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই (১৮৯৯-১৯০১) চীন এক ব্যাপক গণবিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল। এই গন অভ্যুত্থানই চীনের ইতিহাসে বিখ্যাত বক্সার বিদ্রোহ নামে পরিচিত। প্রথম চীন জাপান যুদ্ধের পর যখন বিদেশী শক্তিগুলো স্ব-স্ব স্বার্থে চীনের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করতে তৎপর হন, তখন বিদেশীদেরকে দেশ থেকে অপসারনের জন্য এবং দেশকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদিতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য বক্সার নামে একটি গুপ্ত সমিতি উনবিংশ শতকের অন্তিমলগ্নে এবং বিশ শতাব্দির প্রারম্ভিক পর্বে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। চীনে এই বিদ্রোহ আই-হো- চুয়ান নামে পরিচিত। বিদেশীরা এই বিদ্রোহকে “বক্সার বিদ্রোহ” নামে আখ্যায়িত করে ছিল।
বক্সার বিদ্রোহের উৎপত্তি
বক্সার সমিতি ছিল অষ্টাদশ শতকের অষ্টত্রিগ্রাম সমিতির প্রশাখা। বক্সার সমিতির মূল নাম ছিল আই-হো-চোয়ান বা মুষ্টি যোদ্ধাদের ন্যয়ভিত্তিক ভ্রাতৃসংঘ। আই-হো অর্থ ন্যায়পরায়নতা এবং চুয়ান শব্দের অর্থ মুষ্টিযুদ্ধ। এই সমিতির সদস্যরা দেহ ও মনের সঙ্গে সমন্ময় সাধনের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করতেন।
চিয়া চিং যুগে (১৭৯৬-১৮২০) অষ্টত্রিগ্রাম সমিতি নামে গুপ্তসমিতির মধ্যেই বক্সারদের উৎপত্তি হয়েছিল। এই ট্রায়াগ্রাম সেন্ট পাকুয়া নামে পরিচিত ছিল। পা-কুয়া চিও “হোয়াইট লোটস সোসাইটি” নামে একটি মাঞ্চু বিরোধী গুপ্তসমিতির সাথে যুক্ত। পাকুয়া চিও এর ভেতরে আই হো চোয়ান নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠেছিল। বহু বছর পরে বিদেশীরা আই হো চোয়ানের সদস্যদের বক্সার নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথম দিকে এই সমিতি ছিল মাঞ্চু রাজবংশ বিরোধী। ১৮৯০ এর দশকের আই-হো-চুয়ান সদস্যরা মাঞ্চু রাজবংশ বিরোধীতার পরিবর্তে উগ্র বিদেশ বিরোধী হয়ে ওঠে।
তারা বিদেশীদের ও তাদের চীনা সহযোগীদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সময়ে আই-হো-চুয়ানের কার্যকলাপকে শানটুং এর রক্ষণশীল গর্ভনর লি-পেং-হো যথেষ্ট মদত দিয়েছিলেন। তাঁর পরবর্তী গর্ভনর ইউ-শিয়েনও তাদের উগ্র সমর্থক ছিলেন। আই-হো চুয়ানের কথাটির অর্থ ছিল ন্যায়পরায়ন ও সমন্বয়পূর্ণ স্থানীয় বাহিনী।
এই সমিতির সদস্যরা দেহ ও মনের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করতেন। অধিকন্তু তাঁরা একপ্রকার যাদুকরী বিদ্যা আয়ত্ত করে ধর্মগত আচার পালন করতেন। প্রয়োজনীয় কোন মন্ত্র তাঁরা তিনবার উচ্চারণ করতেন,মুখে ফেনা উঠাতেন এবং দাঁত দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এইসব প্রক্রিয়ার ফলে তাঁদের মধ্যে এক অতি প্রাকৃত শক্তি সঞ্চিত হতো। ফলে শত্র“দের গোলাগুলি নাকি তাঁদের দেহ ভেদ করতে পারতো না। বক্সারদের রীতি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে এক টুকরো হলুদ বর্ণের কাগজ যাতে অঙ্কিত থাকত একটি পদহীন মানুষ্য মূর্তি দগ্ধ করা এবং দগ্ধ করাকালীন কিছু যাদু মন্ত্র অনুচ্ছাস্বরে উচ্চারণ করা। ফলে আবির্ভূত হতো স্বর্গীয় সেনাদল ও সেনাপতিবৃন্দ যা যুদ্ধে জয়লাভ করতে সহায়তা করত। বিদেশীদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষনের দরুন বক্সারগন বন্দুক ব্যবহার না করে প্রাচীন ধরনের তরবারি ও বর্শা ব্যবহার করতেন। এর ফলে আন্দোলন করীদের মধ্যে প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টাই প্রতিফলিত হয়েছে।
বক্সার বিদ্রোহের কারণ ঃ
বৈদেশিক শক্তির উচ্ছেদ সাধন, খৃষ্টধর্ম প্রচারে বাধা দান এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ভিত্তিক সংস্কার প্রবর্তনে বিরোধীতা এই তিনটি উদ্দেশ্য সম্মুখে বলে বক্সার সমিতি ১৯০০ সালে যে বিদ্রোহ ঘোষনা করে তার পাশ্চাতে বিদ্যমান ছিল একাধিক কারণ, নিন্মে তা প্রদত্ত হল।
খ্রীষ্টধর্মের প্রতি বিদ্ধেষ
কনফুসীয় মতবাদ, তাওবাদ এবং বৌদ্ধধর্মের দ্বারা অনুপ্রানীত চীনারা খ্রীষ্টধর্মের অনুপ্রবেশ কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। খ্রীষ্টান মিশনারীরা চীনে যখন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তখন চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই এটিকে তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করেছিলেন। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে তিয়েন্তসিনের চুক্তির মাধ্যমে খ্রীষ্টান মিশনারীরা চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছিলেন, এবং ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে কনভেনশন অফ পিকিং এর মাধ্যমে তাঁরা চীনে জমি কেনা-বেচার অধিকার লাভ করেছিলেন।
চীনের জনসাধারণ এবং খ্রীস্টান মিশনারীদের মধ্যে ১৮৬০ এর দশক থেকেই তিক্ত সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল। তবে ১৮৯০ এর দশকে এই তিক্ততা সংঘর্ষে রুপান্তরিত হয়। ১৮৯৫ সালে গুজব রটে যে, বিদেশীরা খুব শীঘ্রই সি চুয়ান আক্রমণ করবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে চেং ডু এবং তার পাশ্ববর্তী জেলা গুলিতে প্রবল হিংসাতœক ঘটনা ঘটতে থাকে। আগস্ট মাসে শ্বেতপদ্ম সমিতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নিরামিষাশী গোষ্ঠীর সদস্যরা ফুজিয়ানের অন্তর্ভুক্ত গুচিয়ান শহরে প্রচুর খ্রীস্টান গির্জা অগ্নিদগ্ধ করেন এবং ৯ জন খ্রীষ্টান মিশনারীকে হত্যা করেন। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ ধরে হুনান , হুসবোই, চিয়াংশু, চিশুয়াং, শানটুং প্রভৃতি অঞ্চলে অনুরুপ বহু ঘটনা ঘটে। শান্টুং অঞ্চলে দুই জন মিশনারী নিহত হলে জার্মানী উক্ত ঘটনাকে সামরিক অভিযান চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে। এর পরেই পশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ চীনকে নিজেদের “প্রভাবাধীন অঞ্চল” এ ভাগ করে নেয়।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনরোষ ঃ
১৮৯৭ -৯৮ সাল নাগাদ বিদেশী শক্তিবর্গ যখন চীনকে নিজেদের “প্রভাবাধীন অঞ্চলে ভাগ করে নেয়” তখন চীনারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বাধীনতা লুপ্তির আশঙ্কায় আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন। চীনের সংস্কার আন্দোলনের নেতা কাং ইউ ওয়েই ১৮৯৮ এর ১৭ই এপ্রিল জাতীয় সুরক্ষা সমিতির সদস্যদের সামনে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে বিদেশী অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে চীন অচিরেই বর্মা, আন্নাম, ভারতবর্ষ বা পোল্যান্ডের মতো একটি পরাধীন দেশে পরিণত হবে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকেই বিদেশীদের হত্যা করতে আরম্ভ করেন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি
বক্সার আন্দোলন শুরুর পূর্ব থেকেই চীনের ব্যবসায়ের বাজারে মন্দা দেখা দেয়। অহিফেন যুদ্ধোত্তর বৎসরগুলিতে ক্রমঃবর্ধমান বিদেশী পন্য আমদানি চীনের অর্থনীতির উপর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে ইয়েলো নদীর বন্যার ফলে শানটুং প্রদেশে খাদ্যাভাব ঘটে এবং জনগণ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। উত্তর চীনে খাবার জন্য ফসলের ফলন আশাপ্রদ হয় না। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্যের সন্ধান নানা দুঃখ-কষ্ট বরণ করে বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়। চীনে বিদেশী তুলাজাত বস্ত্রাদী ও বিদেশী তৈল আমদানি হওয়ায় স্থানীয় তুলা ও তৈল ব্যবসায়ীদিগকে ক্রয় বিক্রয়ের বাজারে মন্দার সম্মুখীন হতে হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা সূতিবস্ত্রের মূল্য চীনে প্রস্তুত সূতিবস্ত্রের মূল্য যথেষ্ট কম হওয়ায় বাজারে দেশী সূতি বস্ত্রের বিক্রয় হ্রাস পায়। ফলে বহু চীনা তাঁতির জীবিকা উপার্জন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। আবার নতুন রেলপথ নির্মানের প্রস্তাব পশুবাহিত এবং হস্তচালিত শকটের মালিকেরা এবং তরী ও বজরার মালিকগণ উপার্জন হ্রাসের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়। তাইপিং বিপ্লবের পূর্বে চীনে যে অর্থনৈতিক অবনতি পরিলক্ষিত হয় তা বিপ্লবোত্তর বছর গুলোতেও বিদ্যমান থাকে। ১৮৯৯ সালে চীনের ব্যবসায়ে ঘাটতির মূল্য দাড়ায় ৬৯ মিলিয়ন টিল। এইভাবে উনবিংশ শতকে শেষার্ধে চীনের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটে । অর্থনীতিক দুরবস্থার জন্য বক্সার সমিতি চীনের উপর বৈদেশিক প্রভাবকে দায়ী করে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি সংকট
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি চীনে কৃষি সংকট বাড়িয়ে তুলেছিল। আলবার্ট ফুয়েরওয়ার্কারের “ঞযব ঈযরহবংব ঊপড়হড়সু” (১৮৭০-১৯১১)নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭৩ থেকে ১৮৯৩ সালের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৮ শতাংশ,অথচ একই সময়ে চীনে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কৃষিজমির পরিমান বৃদ্ধি অত্যন্ত নগণ্য। ফলে জমিতে ভিড় উপচে পড়ে এবং চাষীদের কৃষিজমির মাপ ক্রমশ ছোট হতে থাকে। তৎকালীন চীনে কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ ছিল অত্যন্ত সামান্য। ফলে উন্নতমানের সার, বীজ বা প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল না । ভাড়াটে চাষীদের উৎপাদনের অর্ধেক বা কোন কোন ক্ষেত্রে আট দশমাংশ পর্যন্ত কর দিতে হত। এতে একজন ভাড়াটে চাষীর পক্ষে তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ করা অতি কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা তখন মহাজনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হতেন এবং ঋণভারে জর্জরিত হতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের ভূমিচ্যুত করা হত। ১৮৯৮ সাল নাগাদ ভূমিহীন চাষী,ভবঘুরে এবং ভিখারীর সংখ্যা চীনে বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এরাই পরবর্তী কালে বক্সার বিদ্রোহে যোগদান করেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটকে ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ । ১৮৫২ সালে ইয়েলো নদী হুনান থেকে শানটুং এর দিকে গতি পরিবর্তন করে। ১৮৮২সালের পর থেকে শানটুং অঞ্চলে মাঝে মাঝে বন্যা হতে থাকে। ১৮৯৮সালে এক বিধ্বংসী বন্যার ফলে শানটুং এর প্রায় শতাধিক গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সে চুয়ান,কিয়াংসি, কিয়াসু,আনহয়েই প্রভৃতি অঞ্চল ও অনুরুপ বিধ্বংসী বন্যার শিকার হয়। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর চীনে মারাতœক খরা দেখা দেয়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে চীনের জনসাধারনের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় চীনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পন্ডিতেরা ও রাজপুরুষেরা প্রচার করতে থাকেন যে, বিদেশী ও খৃষ্টধর্মের কুপ্রভাবের ফলেই চীন নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দ্ধারা আক্রান্ত হয়েছে। ফলে চীনের সাধারন মানুষের বিদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্ধেষ পূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সামাজিক অসন্তোষ
তখন সম্রাট কুয়াং সুর নেতৃত্বে এবং তাঁর প্রধান উপদেষ্টা কাং ইউ ওয়েই এর সহযোগিতায় চীন সমাজ কে পাশ্চাত্য ধাঁচে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলে। বক্সার আন্দোলনের পূর্বে চীনের দক্ষিণ এবং মধ্য অঞ্চলে ণড়ঁহম ঈযরহধ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল চীনকে পশ্চিমী সভ্যতায় দীক্ষিত করা। সম্রাট কয়াং সু ও দেশে পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রাসারের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতাকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি অনেকগুলো রাজাজ্ঞা প্রচার করেন। বক্সার সমিতির মতে এই ভাবে পশ্চিমা ধাঁচে সমাজ পুর্নগঠনের চেষ্টা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়, যেহেতু এরূপ প্রচেষ্টা ঐতিহ্যমন্ডিত চীনা সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করার সমতুল্য। এরূপ পরিস্থিতি বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
বক্সার বিদ্রোহোর প্রসার
বক্সার বিদ্রোহের ইতিহাসে ১৮৯৯ সাল একটি স্মরণীয় বৎসর। ঐ বৎসরেই বক্সারগন সমগ্র দেশব্যাপী বিদেশী বিতাড়নের আন্দোলন শুরু করে। প্রথম অবস্থায় আন্দোলন আতœপ্রকাশ করে প্রদেশ গুলোতে । প্রদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আন্দোলন বেশি জোরদার হয় শানটুং প্রদেশে। ২৮মে ১৯০০সাল পিকিং এ বিদেশীদের বিতাড়নের জন্য কুটনীতিবিদদের সতর্ককরা হয়। ১৩জুন বিদ্রোহিরা পিকিং এ অবস্থিত গীর্জা ও সাধারণ বিদেশীদের বাসস্থান অগ্নিদগ্ধ করে, ধর্মান্তরিত চীনা খ্রীস্টানদিগকে হত্যা করে অথবা জীবন্ত অবস্থায় কবরে সমাহিত করে। ১৪জুন ১৯০০ সাল বক্সার বিদ্রোহীগন বিদেশী দূতাবাসের প্রহরীদের উপর আক্রমণ চালায়। ২০জুন পিকিং এ নিযুক্ত জার্মান মন্ত্রি ঈষবসবহং ঠড়হ কবঃঃষবৎ কে হত্যা করে। পিকিং এর ন্যায় তিয়েনসিনেও বিদ্রোহিরা হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৬জুন সম্রাজ্ঞী জু’ সী একটি সভা আহ্বান করে। ১৯জুন ওসঢ়বৎরধষ ঈড়ঁহপরষএ সিদ্ধান্ত হয় যে বিদেশীদের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বক্সারদের সহায্যে বিদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করা হবে।
বিদেশীদের সাথে যুদ্ধ
বিদেশীদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে মাঞ্চু দরবার প্রাদেশিক শাসনকর্তাদিগকে আদেশ দেন, তাঁরা যেন বক্সারদের সংগঠিত করেন। ফলে প্রিন্স চুয়াং এবং কাং-ই ত্রিশ হাজার বক্সারদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আর প্রিন্স তুয়ান অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন ১৪০০ বক্সার দলের । এক একটি দল গঠিত হয় ১০০ থেকে ৩০০ বক্সার নিয়ে। জেনারেল তুং খফুসিয়াং এর অধীনে সরকারী সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে বক্সারগণ দূতাবাসের উপর আক্রমণ শুরু করে ২১ শে জুন। দূতাবাস অবরুদ্ধ হয়। দূতাবাসে তখন ৪৫০ জন রক্ষী, ১২জন বৈদেশীক মন্ত্রী সমেত ৪৭৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি, ২৩০০ চীনা খ্রীস্টান এবং প্রায় ৫০ জন ভৃত্য অবস্থান করছিল। আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রচন্ড বাধা দান করেন। বিদেশী মিত্র শক্তিবর্গ তখন আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠন করে পিকিং এর দূতাবাসের অবরোধ অবসানে উদ্যোগী হন। বিদেশী সেনাবাহিনী ১৪ জুলাই টিয়েন্টসিন দখল করে এবং ৪আগষ্ট পিকিং অভিমুখে যাত্রা করে। এই আন্তর্জাতিক বৈদেশিক বাহিনীতে মোট ছিল কিঞ্চি দুর্ধ ১৮হাজার সৈন্য। তন্মধ্যে ৮০০০ জাপানী সৈন্য, ৪৮০০ রুশ সৈন্য, ৩০০০ বৃটিশ সৈন্য, ২১০০ মার্কিন সৈন্য, ৮০০ ফরাসী সৈন্য, ৫৮ অস্ট্রিযার সৈন্য,৫৩ ইতালীয় সৈন্য। বিলম্বে জার্মান সৈন্য আস্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান করেন। টিয়েন্টসিন পিকিং পথ ধরে আন্তর্জাতিক বাহিনী পিকিং এ উপস্থিত হয় এবং বক্সার বাহিনীকে সম্পূর্ন রূপে পরাজিত করে ১৪ আগষ্ট দূতাবাসের অবরোধের অবসান ঘটায়।
বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি ঃ
ঐতিহাসিক জী শ্যেনো বলেছেন, বক্সার অভ্যূত্থান ছিল চীনাদের একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া এবং খ্রীস্টান মিশনারী ও ধর্মান্তরিত চীনা খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তিনি আরো বলেছেন,এটি ছিল গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক বিদ্রোহ। বিদ্রোহীদের প্রায় ৭০শতাংশ এসেছিল কৃষক পরিবার থেকে। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন ক্ষেতমজুর এবং এঁদের বয়স ছিল অত্যন্ত কম (সাধারনত ১২-১৮বছর বয়সের মধ্যে)। তাছাড়া, নৌকার মাঝি, ফেরিওয়ালা, কুলি, কর্মচ্যুত হস্তশিল্পী, ছোট দোকানদার, স্কুলশিক্ষক প্রভৃতিও এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করেন।
হৃ বিদ্রোহীদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র শ্রেণীর লোক। তবে পিকিং এর রাজসভা যখন থেকে বক্সারদের সমর্থন করতে থাকে,তখন প্রচুর রাজপুরুষ এবং জেন্ট্রির সদস্যরা বক্সারদের মদত দিয়েছিল।
হৃ বক্সার গণ-অভ্যুত্থানের নারীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁরা কতগুলি বিশেষ সংগঠনে বিভক্ত ছিলেন। ১২-১৮ বছর বয়সী মেয়েরা লাল লন্ঠন বাহিনীর সদস্য ছিলেন। নীল লন্ঠন বাহিনীর সদস্যা ছিলেন মাঝবয়সী গৃহবধুরা।
হৃ খ্রীস্টধর্মের বিরোধিতা এবং বিদেশী বিরোধিতা ছিল বক্সার বিদ্রোহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রথমদিকে অবশ্য এই বিদ্রোহ ছিল একই সাথে চিং রাজবংশ বিরোধী এবং বিদেশী বিরোধী। তখন বিদ্রোহিদের স্লোগান ছিল – “চিং বংশকে উৎপাটিত কর এবং বিদেশীদের খতম কর।
হৃ প্রকৃতপক্ষে বক্সার বিদ্রোহীদের কোন উন্নতমানের সামাজিক কর্মসূচী ছিল না। একটি বিদ্রোহকে সফল করার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন সে ধরনের কোন দক্ষ সংগঠনও বক্সারদের ছিল না।
হৃ চীনের ভূস্বামী শ্রেণী এবং একদল রাজপুরুষ বক্সার বিদ্রোহের সমর্থন করেছিলেন। কারণ, তাঁদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী ছিল পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল ভাবধারার পরিপন্থী। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বহু বছর পর বক্সার বিদ্রোহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বক্সার বিদ্রোহ ছিল একটি স্বতঃস্ফুর্ত কৃষক বিদ্রোহ।
বক্সার প্রোটকলঃ
বিদ্রোহ দমনের পর চীনকে খন্ডিত বিখন্ডিত করবার এমন সূবণ সুযোগ বিদেশী শক্তিবর্গ পূর্বে কখনও পাননি। তথাপি তাঁরা চীনের সার্বভৌমিকতা ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখতে সম্মত হন। চীনের পরাজয় এবং বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর বিদেশী শক্তিসমুহ চীনকে ১২ টি শর্ত সম্বলিত একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয় ১৯০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর । ১৯০১ সালে ৭ডিসেম্বর চীন এবং ১১টি বিদেশী শক্তির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তি “বক্সার প্রোটকল” নামে বিখ্যাত। চুক্তির শর্ত গুলো চীনের পক্ষে যথেষ্ট অপমান জনক। অথচ চীনের পক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষর না করে কোন উপায় ছিল না। শর্তগুলো ছিল নিম্ন রুপ ঃ
প্রথমত, ১২জন রাজপুরুষ যাঁরা বক্সারদের বিদেশ বিরোধী আন্দোলন যোগদান করেছিলেন তাঁদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় অথবা আতœহত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তা ছাড়া আরও শ’খানেক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। যে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রেই এটি ছিল একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত।
দ্বিতীয়ত, চীনকে এক বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দানে বাধ্য করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, চীনকে ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ক্ষতিপূরণ ১৯০১ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে বিভিন্ন কিস্তিতে দিতে হবে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ছাড়াও ইটালি,নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, স্পেন , পর্তুগাল এবং স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশগুলোও চীন থেকে প্রাপ্ত ক্ষতি পূরণের অংশীদার হবে। তৃতীয়ত,যেসব শহরে বিদেশী বিরোধী আন্দোলন তীব্র রুপ নিয়েছিল সে সব অঞ্চলে সরকারী পরীক্ষা ব্যবস্থা ৫ বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। কমপক্ষে ৪৫ টি শহরে পরীক্ষা ব্যবস্থা বাতিল হয়।
চতুর্থত, পিকিং এর বিদেশী দূতাবাসগুলিকে পাহারা দেবার জন্য বিদেশী সৈন্য বাহিনী স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হল।
পঞ্চমত, পিকিং থেকে সমুদ্র পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলিতে এবং রেলপথে বিদেশী সৈণ্য মোতায়েন করা হল।
ষষ্ঠত, সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে চীন বিদেশ থেকে কোন অস্ত্র বা যুদ্ধসামগ্রী আমদানী করতে পারবে না।
সপ্তমত, জার্মানী ও জাপানের কাছে চীনকে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সরাসরি কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
বক্সার প্রোটকলের সমালোচনা
১. বক্সার প্রোটকল চীনের সার্বভৌমিকতা ক্ষুন্ন করে। বিদেশ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ করণ, টাকু এবং অন্যান্য দূর্গের ধ্বংস সাধন, দূতাবাস গুলিতে এবং পিকিং থেকে সমুদ্রোপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিদেশী সৈন্য মোতায়েন রাখার অনুমতি দান, এসমস্তই চীনের সার্বভৌমিকতা ক্ষুন্ন করে।
২. চীনে বিদেশী কুটনীতিকদের সংগঠন চীনা সম্রাটের মর্যাদার হানিকর হয়।
৩. বক্সার বিদ্রোহকালে বিদ্রোহীদের নৃশংসতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের ভাবমূর্তি অনেকাংশে বিনষ্ট করে।
৪. চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত করা হয় ।
বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণ ঃ
১. বক্সার বিদ্রোহিদের কোন উন্নত মানের সামাজিক কর্মসূচি ছিল না। একটি বিদ্রোহ সফল করার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োাজন ছিল তা বক্সারদের ছিল না।
২. বক্সার বিদ্রোহীদের মতাদর্শগত ত্র“টি ছিল। তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে।
৩. তাদের কোন উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র ছিল না। বক্সার দের অস্ত্রের মধ্যে ছিল তীর,ধনুক ইত্যাদি। তারা যুদ্ধ করেছিল মধ্যযুগীয় অস্ত্র দিয়ে , অপরদিকে বিদেশীরা আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে।
৪. চীনা রাজদরবার থেকে বিদ্রোহীদের যখন সমর্থন দেয়া হয় তখন বিদ্রোহীরা নিজেদের শক্তির চেয়ে রাজদরবারের সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর শীল হয়ে পড়ে । এতে নিজেদের ভিতরে অনুশীলনের অভাব দেখা দেয়। রাজদরবারের সমর্থন বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ।
বক্সার বিদ্রোহের মূল্যায়ন ঃ
১. বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঊৎরপ ঐড়নংনধসি তাঁর ঢ়ৎরসরঃরাব জবনবষং নামক গ্রন্থে বলেছেন, বক্সার বিদ্রোহ ছিল সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিবাদের আদিম অভিব্যক্তি।
২. রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন বলেছেন, তাইপিং বিদ্রোহের মত বক্সার বিদ্রোহও ছিল একটি কৃষক আন্দোলন।
৩. প্রখ্যাত আমেরিকান উপন্যাসিক মার্ক টোয়েন “সভ্যতার তথাকথিত রক্ষক ” নামক গ্রন্থে বক্সার বিদ্রোহীদের উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন।
৪. গনপ্রজাতন্ত্রি চীনের ঐতিহাসিকরা বক্সার বিদ্রোহকে দেশপ্রেমিক চীনাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সর্বশেষ বলা যায় যে, বক্সার বিদ্রোহ ছিল বৈদেশিক শক্তির উচ্ছেদ সাধন এবং চীনা প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি সংগ্রাম।
কি বিদ্রোহ বক্সার বিদ্রোহ না বিপ্লব ?
বিপ্লব ও বিদ্রোহ শব্দ দুটিতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কোন দেশের সামাজিক,রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক তথা প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশের জনগনের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণে যে আন্দোলন শুরু হয় এবং যা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো গঠিত হয় অর্থ্যাৎ প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে। যেমন ঃ- ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লব। অপর পক্ষে যে আন্দোলন উক্ত পরিবর্তন গুলো করতে সক্ষম হয় না তাকে বিদ্রোহ বলি। যেমন ঃ- ১৮৫৭সালের ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ।
বক্সার বিদ্রোহ ছিল একটি বিদেশ বিরোধী বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। এখানে চীনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় নি। অধিকন্তু এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে বক্সার বিদ্রোহ ছিল চিনা জনগনের বিদ্রোহ, বিপ্লব নয়।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে তবুও বক্সার বিদ্রোহের মাধ্যমে চীনের জনগণের দেশপ্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। এই বিদ্রোহের ফলে চীনা জনগণের মধ্যে নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবধারা ধরে রখার যে মনোভাব পরিলক্ষিত হয় তা সত্যি বিস্ময়কর। এই আন্দোলনের প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় যখন এই আন্দোলন বিংশ শতকে পৃথিবীব্যপী আধুনিক উপনিবেশিকতার বিরোধী হিসাবে বিবেচিত হয়। এই বিদ্রোহের পর মাঞ্চু সরকারের দূর্বলতা দেশে মাঞ্চুবিরোধী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। মাঞ্চুবিরোধী আন্দোলনের রুপকার ডঃ সুন ইয়ৎ-সেন এর নেতৃত্বে চীনে ১৯১১ সালে যে বুর্জোয়া গনতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয় তা ছিল এই বক্সার আন্দোলনের পরোক্ষ ফসল।
Thanks for your post....
২১ জানুয়ারী, ২০১৭ এ ৯:৩২ PM
টিকা অসমান সন্ধি
৩ নভেম্বর, ২০১৭ এ ৯:২১ AM
টিকা সানকিন কোটাই
৩ নভেম্বর, ২০১৭ এ ৯:২২ AM
ব্রিটেনের দেখাদেখি মার্কিন যুক্তাষ্ট্র ওহ ফ্রান্স চীনকে তাদের সঙ্গে অনুরূপ অবাধ বাণিজ্য করার সন্ধি করতে বাধ্য করলেন।এই সন্ধিগুলো "অসমান।
২২ জুন, ২০১৯ এ ১১:৩৩ AM
আই হো চুয়ান কে ছিলেন এটা কোনো লোক এর নাম নাকি বিদ্রোহের???😫
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ ৯:০৪ AM
মঞ্জু শাসক কে ছিলো
২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ এ ৯:৫৭ PM
টিকা:বাকুফু
১৬ এপ্রিল, ২০২০ এ ১০:১৬ AM
Khub bhalo helpful, knowledgeable and time saving, great note
৯ আগস্ট, ২০২১ এ ৮:৫০ AM
পিকিং কনভেশন কাদের মধ্যে হয়
২০ জানুয়ারী, ২০২২ এ ১:৪৪ AM