Blogger Templates by Blogcrowds

ধর্মনিরেপক্ষ সাম্প্রদায়িকতা ও বিশ্বায়ন

মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৩

বাহ্যিক দৃষ্টিতে  বিশ্বায়ন ও জাতিয়তাবাদ পরস্পরবিরোধী দু’টি মতবাদ। কালের বাঁকে বাঁকে মানুষ অপরের সহিত  সামঞ্জস্যতাকে সন্ধান করেছে নিজের প্রয়োজনে। কখনো ভাষা, কখনো বর্ণ আবার কখনো আঞ্চলিক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে মানুষ ঐক্য গড়ে তুলেছে।  যার মাধ্যমে সে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব অর্থাৎ নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আর সেই সুসামঞ্জস্যশীল ব্যবস্থাটি টিকেনি। স্বার্থের দ্বন্ধই তৈরী করেছে একই সমাজে ভিন্ন মতাদর্শিক মানুষের। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য উপাদান যেমন, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি। এই ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার জন্য উদ্ভব ঘটে জাতি-রাষ্ট্রের  ধারণা। একই মতাদর্শভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও তাতে সকলের সমান অধিকার রক্ষিত হয়নি।
তাছাড়া এই জাতি-রাষ্ট্রসমূহ একে অপরের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। প্রত্যেকেই নিজের অঞ্চল বৃদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় উপনিবেশবাদের। কিন্তু, উত্তর উপনিবেশবাদী বিশ্বে কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠী নিজেদের কর্তৃত্বকে বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বিশ্বায়নের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে। যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিয়তাবাদী চেতনার বিলোপ সাধন করে একটি একক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়। পশ্চিমাদের এই একক বিশ্বব্যবস্থার অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতার নগ্নমূর্তি। বিশ্বায়নের অন্যতম একটি উপাদান হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। ঐশী ধর্মকে বিকৃত করার ফলে খ্রীষ্ট ধর্মের যে কঙ্কাল তার অনুসারীদের সামনে হাজির হয়েছে তা’ তাদেরকে সমৃদ্ধির পথ দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজেরাই তৈরী করে নিয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নামক এই ব্যবস্থাটি। উপনিবেশবাদের ভেলায় চড়ে এই অসার মতবাদ পৌছে যায় পৃথিবীর সর্বত্র। মানব রচিত এই মতবাদের অন্তর্নিহিত অসারতার কারনে চিন্তাশীল মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে এর রচয়িতাদের আটতে হয় নানা কূটকৌশল। বিশ্বব্যাপী রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা শিকার হয় পশ্চিমাদের কূট কৌশলের। দ্রুত অগ্রসরমান পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির বিকাশ ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত মজবুত করে তুলে। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ক্রমশ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। কখনো সমাজতন্ত্র , কখনো সন্ত্রাসবাদ আবার কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে উদারতাবাদের মুখোশ নিয়ে পশ্চিমা শক্তি তৈরী করে চলছে নতুন নতুন রণক্ষেত্র। বস্তুতান্ত্রিক চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট লোক তৈরীর মাধ্যমে সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তকে যাকে উল্লেখ করা হচ্ছে উদারতাবাদ হিসেবে। মনুষত্বের অবক্ষয় নিয়ে চতুর্দিকে হাহাকারের ভেতর দিয়েই প্রতিমূহুর্তে তৈরী হচ্ছে মানবতা বিধ্বংসী নতুন প্রজন্ম। প্রগতিশীলতার আবরনে প্রতিক্রিয়াশীলতার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠা এই প্রজন্মের কাছে ধর্ম মানেই ধ্বংসাত্মক। অতএব এক রুখতে হবে এর অনুসারীদের রুখতে হবে।
বিশ্বায়ন, জাতিয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এর প্রভাব নিয়েই সাজানো হয়েছে এই প্রবন্ধটি।

জাতিয়তাবাদ 
বর্তমান জাতিয়তাবাদের ধারণাটি পূর্বে না থাকলেও মানুষের মাঝে একধরনের দেশাত্মবোধের (Patriotism) চেতনা ছিল, যার ভিত্তিতে সে তার গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীর মানুষকে ভালবাসত। পৃথিবীর অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষ থেকে নিজেকে পৃথক করে চিন্তা করত। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র মানুষের এই চেতনাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে। এখানে মানুষ অন্যান্যদের মাঝে নিজের সামঞ্জস্যতা খুজতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এই স্বাচ্ছন্দবোধ ও মানুষের চাওয়া পাওয়ার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক জাতিয়তাবাদের ধারণা। বর্তমান সময়ের জাতিয়তাবাদী তাত্ত্বিকদের মাঝে তাই এর সংগায়নের ক্ষেত্রে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর এর প্রতি গুরুত্ব দিতে দেখা যায়। আধুনিক কালের জাতিয়তাবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ‘কার্ল ডব্লিউ ডয়েস’, তিনি বলেন,
আজকের যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামে জাতিয়তাবাদ হলো মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত শ্রেণীর বিশালসংখ্যক মানুষের একাত্মতা যারা আঞ্চলিক কেন্দ্রের সহিত সংযুক্ত; এবং সামাজিক শ্রেণীসমূহকে সামাজিক যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে (শাখা- উপশাখামূলক) যোগসন্ধি এবং প্রত্যক্ষভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ১

ডয়েস যুক্তি পেশ করেন যে, আধুনিকায়ন ও জাতিয়তাবাদ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। জাতিয়তাবাদ বিষয়ক তাঁর ধারণার মূলে রযেছে সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন হলো একটা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পুরাতন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক দৃঢ়বদ্ধতাগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অথবা ভেঙ্গে পড়ে এবং জনগণ নতুন ধাঁচের সামাজিকতা গ্রহণ করতে তৈরী হয়ে যায়। সেজন্য জাতিয়তাবাদ ব্যক্তির আবেগপ্রবণ প্রয়োজনীয়তাকে পূরণ করে, যদিও সেই ব্যক্তি সামরিকতাবাদ বা অন্যকোন মতবাদকে গ্রহণ করে ঠিক একই উদ্দেশ্য পূরণ করার মানসে। তাঁর মতবাদের মূলকথা হল একিভূতকরণ, যদিও তিনি সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতাবাদকেও স্বীকার করেন।  জাতিয়তাবাদী আধুনিক গবেষকদের মধ্যে আরেকজন হলেন ‘আর্নেষ্ট জেলনার’। জেলনার তাঁর জাতিয়তাবাদী ধারণায় বলেন,
দুইজন ব্যক্তির জাতিয়তা একই হয় যদি তারা একই সংস্কৃতির হয়। সংস্কৃতির মানে হল মতাদর্শ, সংকেত, নিদর্শন এবং সংঘবদ্ধতার তথা আচার আচরণ ও ভাবের আদান প্রদানের একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম।
দুইজন ব্যক্তির জাতিয়তা একই হয় যদি এবং শুধুমাত্র যদি তারা এক অপরকে একই জাতির বলে মনে করে।২
তার মতে, মানবজাতি তিনটি স্তর পার করে এসেছেঃ ১) কৃষিপূর্ব যুগ ২) কৃষি নির্ভর এবং ৩) শৈল্পিক যুগ। কৃষি নির্ভর যুগে কোন একক প্রভূত্বশীল সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিলনা। সাংস্কৃতিক পরিসীমার আলোকে এযুগের সবকিছুই রাজনৈতিক স্বত্ত্বার বিরুদ্ধে সোচ্ছার ছিল। এযুগে রাজনৈতিক স্বত্ত্বাগুলো দু’ভাগে বিভক্ত ছিলঃ স্বশাসিত স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং বিশাল সা¤্রাজ্য। জাতিয়তাবাদ হলো তৃতীয় স্তর বা শৈপ্লিক যুগের সৃষ্টি। এটা এযুগের শ্রম-বিভাজনমূলক বৈশিষ্ট্যাবলী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। শিল্পায়ন একটা গতিশীল এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমজাতীয় সমাজের জন্ম দেয়। আর শিল্পায়নের ব্যাপারে বলতে গিয়ে জেলনার আধুনিক সমাজে জাতিয়তাবাদের চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে,
যখন আধুনিকায়নের ঢেউ বিশ্বব্যাপী প্রবাহিত হয় তখন এটা সুনিশ্চিত করে প্রত্যেকেই অনুুভব করে যে, অন্যায় আচরনের ভুক্তভোগী এবং সে এ ব্যাপারে তার ভিন্ন জাতিসত্তা হওয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে। যদি সে যথেষ্ট সংখ্যক ভূক্তভোগীকে একই জাতিভূক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তখনই জন্ম নেয় জাতিয়তাবাদের । যদি এ জাতিয়তাবাদ সাফল্য লাভ করে, অবশ্য সবগুলো করেনা, তখন জন্ম নেয় একটা জাতির।৩

ডয়েস এবং জেলনারের যুক্তির ভেতরে অনেক সাজুয্য রয়েছে। যেমন মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আধুনিকায়ন, গণ-বিচ্যুতি ও (জাতীয়) পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা, যোগাযোগের গুরুত্ব ইত্যাদি। তবে জেলনার গুরুত্বারোপ করেছেন আধুনিকায়নের দস্তুর প্রক্রিয়া এবং শিল্পভিত্তিক আধুনিকতার পথে বিভিন্ন সম্ভাব্য বিবর্তনের উপর। ডয়েস যেখানে ভাষার উপর খুব বেশি জোর দিয়েছেন, সেখানে জেলনার অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের উপরও জোর দিয়েছেন।  


বিশ্বায়ন 
বিশ্বায়ন সম্পর্কিত ধারণায় বিশ্বব্যাপী পরস্পরবিরোধী মতামতের প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়।  প্রতেকেই তার নিজ নিজ আঙ্গিক থেকে  বিশ্বায়নকে ব্যাখা করেছেন। এখানে উন্নত বিশ্ব-অনুন্নত বিশ্ব , সা¤্রাজ্যবাদী-উপনিবেশ, রাষ্ট্রীয় আধুনিক সরকার-বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাঝে দ্বন্ধ বিদ্যমান। বিশ্বায়নের প্রয়োগভূমি হিসেবে তৃতীয় বিশ্বকে বেছে নেয়া হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের তাত্ত্বিকদের কন্ঠে তাই ফুটে উঠেছে একরাশ আপত্তি আর অভিযোগ।
ড. মনযের কাহাফের মতে,
বিশ্বায়ন বর্তমান পৃথিবীর একটি অতি সাম্প্রতিক প্রপঞ্চ। সমগ্র পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব হাতে তুলে নেয়ার জন্য কৌশলী পাশ্চাত্য এ ধরনের শ্লে­াগান মুখে তুলে নিয়েছে। সহজ কথায় সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটা সমাজের বাসিন্দা। ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বিষয় পর্যন্ত সব ব্যাপারেই সবাইকে একই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এটি সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিকতম অস্ত্র।৪

নোবেল বিজয়ী অমর্ত্যসেন এর মতে,
বিশ্বায়ন এখনো বিতর্কিত বিষয়। আজকের বিশ্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হলেও একই সাথে সর্বগ্রাসী বঞ্চনা এবং নিদারুণ বৈষম্যও চলেছে
বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে উন্নয়নশীল দেশে শিল্প কারখানার বিকাশ বাধাগ্রস্থ্য হচ্ছে। অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের নয়াব্যবস্থা হওয়া তো দূরের কথা তাদের যে কর্মসংস্থান আছে তাও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের নাম করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডঞঙ) প্রভাব খাটিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে শাসন করছে।বিশ্বায়নের কোনো  শর্ত (ঈড়হফরঃরড়হং) বা ঘটনা (চযবহড়সবহড়হ) নয়। এ এমন এক প্রক্রিয়া (চৎড়পবংং) যা বহুদিন ধরে ঘটে চলছে।৫
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে,
বিশ্বায়ন হচ্ছে পুঁজিবাদেরই নতুন আচ্ছাদন, পুঁজিবাদ যা বিশ্বে বাজার খোঁজে এবং পুঁজি লগ্নি করে। এতকাল তারা কাজটা করতো সাম্রাজ্যবাদী কায়দায়। যেখানে জবরদস্তি থাকতো। জবরদস্তি এখনও আছে। কিন্তু, এখন তাকে বিশ্বায়ন নাম দিয়ে বেশ ভদ্রগোছের চেহারা দেয়া হয়েছে। যেন সবাই এক বিশ্বের অংশ; ছোট বড় নেই। এখন আর ঔপনিবেশ স্থাপনের ঝুট ঝামেলা নেই। তথ্য প্রযুক্তি রয়েছে। আছে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা। রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা।৬
ড. মনযের কাহাফ, অমর্ত্য সেন এবং ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য থেকে প্রতিয়মান হয় যে, বিশ্বায়ন হচ্ছে পশ্চিমাদের সৃষ্টি এবং এর মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তি শোষণের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। তবে বিশ্বায়নের উদ্ভবের পেছনে কারো সুগভীর উদ্দেশ্য থাক আর না থাক,  বিশ্বব্যবস্থায় সময়ের প্রয়োজনেই এর উপাদানগুলোর জন্ম এবং বিশ্বব্যাপী এর ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিই মূখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাইতো এম. কনফুসিয়াসের মতে,
বিশ্বায়ন হচ্ছে ট্যান্সন্যাশনালিজম। এ পলিসিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশের ‘অধীনতা নীতি’ বলা যায় না।৭
তবে এগিয়ে যাওয়া বা একটি সমন্বিত উন্নত বিশ্বের অংশীদার হওয়ার আহ্বান যারা করে এসেছে তাদে উদ্দেশ্যের আলোকেই চলছে বিশ্বায়নের পরিগঠন প্রক্রিয়া।
সাম্প্রদায়িকতাবাদ
সাম্প্রদায়িকতা হলো একই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যকার সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহের বহিঃপ্রকাশ। তবে তাত্ত্বিক দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে সাধারনত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়ে থাকে। কেননা, পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক কারনে অসংখ্যবার দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়েছে। আবার সাম্প্রদায়িকতার সহিত ধর্ম নামক বিশেষণটি যুক্ত হওয়ার পেছনেও যৌক্তিক কারন রয়েছে।  কেননা, এসকল দাঙ্গা-হাঙ্গামার অধিকাংশের পেছনেই ধর্মীয় অনুভূতির বিকৃত রুপ দায়ী ছিলো।  তবে ধর্মের মৌলিক নীতির সহিত এর কোন সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে বাম বুদ্ধিজীবিদের অন্যতম বদরুদ্দীন উমরের ব্যাখ্যা হচ্ছে,
ধর্মের যে কোন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবহারকেই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া এক মহাতাত্ত্বিক ও বাস্তব ভ্রান্তি। সাম্প্রদায়িকতা হলো ধর্মের এই ব্যবহারের একটি রুপ মাত্র, যেখানে এক ধর্মীয় সম্প্রদায় অন্য একটি সম্প্রদায়ের বিরোধীতা করতে নিযুক্ত থাকে, অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত লোকের ক্ষতি করা তার লক্ষ্য হয়।৮

ইতিহাসের দর্পনে বিশ্বায়নঃ প্রেক্ষিত জাতিয়তাবাদ 
বিশ্বায়ন শব্দের উদ্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলেও ধারণাটি সুপাচীন কাল থেকে চলে আসছিল। অতিতে বিভিন্ন সা¤্রাজ্যের বিস্তারনীতির মাধ্যমে এর ধারণাটি ফুটে উঠে। যেমন, প্রসিদ্ধ আব্বাসীয় খলীফা হারুনুর রশিদ মেঘের এক টুকরোকে দেখে বলেছিলেন,
হে মেঘমালা ! তুমি যেখানেই বর্ষিত হও, তোমার ট্যাক্স কিন্তু আমার কাছে আসবেই।৯
তবে আব্বাসীয় যুগের বিশ্বায়ন আর বর্তমান যুগের বিশ্বায়নের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, আব্বসীয় খেলাফতের অন্তর্গত সকল অঞ্চলে সমবন্টন নিয়ে খলীফারা চিন্তা করতেন, আর বর্তমান বিশ্বায়নের ফল নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। ফলে, শোষিত আর শোষক শ্রেণীর সৃষ্টি হচ্ছে। এবং এই ভূক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মাঝে ঐক্যের চেতনা তৈরী হচ্ছে। যা ধীরে ধীরে জাতিয়তাবাদী চেতনার উন্মষ ঘটায়। বিশ্বায়নের বর্তমান ধারণা  এবং এর ফলাফল পূর্বের সা¤্রাজ্যগুলোর মাঝেও ছিল। তবে সেই অবস্থাকে বিশ্বায়ন বলা যাবেনা। কিন্তু, সেখানে বিশ্বায়নের একধরনের রেশ ছিল । ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ এর গোটা বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন এই চিন্তাধারারই ইঙ্গিত বহন করে। গ্রীকদের বিশ্ব চিন্তাধারার মাঝে একধরনের উগ্র জাতিয়তাবাদের সংমিশ্রন ছিল। যেমন , তারা নিজেদেরকে পৃথিবীর একমাত্র সভ্য জাতি বলে মনে করত। তবে পরবর্তীতে মুসলিম চিন্তাধারাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার যে মিশন নিয়ে রাসূল(সঃ) এসেছিলেন সেখানে মতাদর্শগত বিশ্বায়নের ধারণা লুকিয়ে ছিল। কিন্তু. ইসলামে সকল জাতি-গোষ্ঠীর স্বতন্ত্রতা রক্ষা করেই একটি সার্বজনীন মতাদর্শের কথা বলে। এবং এখানে কোন জবরদস্তি বা দখলদারিত্বের স্থান নেই।



রাজনৈতিক বিশ্বায়ন ও জাতিয়তাবাদ ঃ প্রেক্ষিত সাম্প্রদায়িকতা
জাতিয়তাবাদী চেতনা, সেটি উদারবাদী হোক আর উগ্রপন্থীই হোকনা কেন তার পেছনে রাজনৈতিকদের বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ থাকে। Peter Walter তাঁর ‘ÔNationalismÕ’ গ্র্রন্থে ‘ÔEmancipation and Oppression towards a typology of NationalismÕ নামক প্রবন্ধে কালের প্রেক্ষিতে জাতিয়তাবাদের তিনটি রুপ বর্ণনা করেছেন। সেখানে প্রত্যেকটা জাতিয়তাবাদের পেছনেই মূল চালিকাশক্তি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। পশ্চিম ইউরোপের রাজ্যগুলোতে যে জাতিয়তাবাদের সূচনা হয় তাতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। এ অঞ্চলে সা¤্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একই ভাষা-সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে রাষ্ট্র গড়ে উঠে। পরবর্তীতে এই রাষ্ট্রের জনসমষ্টির মাঝে একটি জাতিয়তাবাদী চেতনা গড়ে তোলা হয়। যাকে পিটার ওয়াল্টার দেখিয়েছেন,  ÔResorgimento Nationalism*’হিসেবে। ঠিক তেমনি তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ও ভারতে মুসলমানদের মাঝে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্র্তৃক জাতিয়তাবাদী চেতনা তৈরীর প্রক্রিয়া চলে। যাকে পিটার ওয়াল্টার দেখিয়েছেন, ÔReform Nationalism*’হিসেবে। আবার ইউরোপে বিংশ      শতাব্দীতে ফ্যাসিজম ও নাজিজমের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরীর প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় ওয়াল্টার সেটিকে দেখিয়েছেন, ÔIntegral Nationalism*’ হিসেবে। জাতিয়তাবাদের উপরোক্ত তিনটি কাঠামো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির আলোকে গঠিত হলেও এর নিয়ামক ছিলো সাম্প্রদায়িক চিন্তা। এবং পরবর্তীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের পেছনে জাতিয়তাবাদী সমাজ গঠনের এই প্রক্রিয়াগুলোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো। ইউরোপে অটোমান সা¤্রাজ্যের অধীন অঞ্চলে জাতিয়তাবাদী চেতনা এবং ক্রুসেডিয় চিন্তার ফলে আজকের সমৃদ্ধ ইউরোপ জন্ম নেয় ঠিকই, তবে এর অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িক চিন্তাই ফিলিস্তিনের মতো রণক্ষেত্র সৃষ্টির অন্যতম নিয়ামক।  ভারতে মুসলমান নেতৃবৃন্দের জাতিয়তাবাদী চিন্তার ফলশ্রুতিতেই জন্ম নেয় পাকিস্তানের মত ইসলামের বিকৃত রুপের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের। যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিলো ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। জাতিয়তাবাদের নামে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনাই পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর শোষণের পথ প্রসারিত করে।
 বিশ্বায়নের ফলে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ঠিকই বিদ্যমান কিন্তু তা সহজে অনুভূত হচ্ছেনা। যেমন বিশ্বব্যাপী বর্তমানে একধরণের পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চলছে। কিন্তু, সাধারণ জনগণের মাঝে কোন অনুভূতি নেই । কারন, প্রত্যক্ষ আক্রমনের পরিবর্তে মানসিক আক্রমনের এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় নেতৃবৃন্দও বেখেয়াল হয়ে পড়েছেন। হয়ত তারা বুঝতেই পারছেননা যে, তার জনগোষ্ঠীর মাঝে জাতিয়তাবাদী চেতনার প্রতিনিয়ত বিলুপ্তি ঘটছে। যাকে Assimilationist Process’ বলা যায়। ফলশ্রুতিতে, জাতিয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। অপর দিকে বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রের জনগণ অন্যান্য দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সহজেই জানতে পারছে। এবং রাষ্ট্রীয় সরকারগুলোও বিশ্বের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অর্থাৎ পশ্চিমাদের ইচ্ছার আলোকেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করতে হচ্ছে। ফলে, জাতীয় নীতি নির্ধারণে সংস্কার করে একটি একক জাতিয়তাবাদী চেতনা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে, বিশ্বায়নের ফলে ÔIntegral NationalismÕ ’ বা উগ্র জাতিয়তাবাদী চেতনা গড়ে উঠার প্রক্রিয়া প্রসারমান। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে XENOPHOBIA বৃদ্ধি পাচ্ছে। নরওয়েতে ব্রেইভিক নামক যুবক কর্তৃক গণহত্যার ঘটনা ইউরোপের বহুসংস্কৃতি সম্বলিত সমাজে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাতবোন রাজ্যগুলোতে মাওবাদী বিদ্রোহীদের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধতার অন্যতম কারন হলো দঢঊঘঙচঐঙইওঅ’   ।
অন্যদিকে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে বা তৈরী করা হয়েছে সে অঞ্চলে পশ্চিমা স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য। যার ফলে, এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মাঝে উগ্র জাতিয়তাবাদী চেতনাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। ২০১১ সালে কর্ণেল গাদ্দাফী ন্যাটোর সৈন্যদের  হাতে বন্দী হলে তারা তাকে হত্যা করে লিবিয়ারই অন্য একটি গোত্রের এক যুবকের দ্বারা। যার মাধ্যমে মূলত গাদ্দাফীর স্বগোত্রীয় লোকদের সাথে হত্যাকারী যুবকের গোত্রের দ্বন্ধ উসকে দেয়া হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এভাবেই বিশ্বায়নের ধারক বাহকরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উগ্র জাতিয়তাবাদ এবং নব্য সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে, শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে।
বিশ্বায়ন, জাতিয়তাবাদ নাকি ষড়যন্ত্র
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে খিলাফত বা মুসলিম উম্মাহ ধারনাটির দ্বান্ধিক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯১৫ সনের ১৪ জুলাই হতে ১৯১৬ সনের ১০ ই মার্চ পর্যন্ত তৎকালীন মক্কার গভর্নর শরীফ হোসাইনের সহিত মিশরে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার ম্যকমোহনের গোপন পত্রালাপ হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে  আরব গোত্রসমূহ ওসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিকে সহায়তা করে। হোসাইন  ম্যকমোহনের এই পত্রালাপের মাধ্যমে আরবদের সাথে ব্রিটিশদের ঐ গোপন সমঝোতার পাশাপাশি ঠিক একই সময়ে আরো কয়েকটি গোপন চুক্তিতে ব্যস্ত ছিলো ব্রিটিশ সরকার। আর এর উদ্দেশ্য ছিলো যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার মাঝে ওসমানিয়া খেলাফতের তুর্কি ও আরব এলাকা ভাগাভাগি করে নেয়া। গোপন চুক্তিগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ছিলো ১৯১৬ সনের ২৬শে এপ্রিল থেকে ২৩শে  অক্টোবর সময়ে সম্পাদিত ‘‘সাইকস্-পিকোঁ’’ চুক্তি। ১৯১৭ সনে  রাশিয়ার  সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় এই চুক্তি প্রকাশ হয়ে গেলেও ততদিনে দজলা ফোরাতের পানি এতদূর গড়িয়েছে যে এর প্রতিবাদ করার কোন গত্যন্তর ছিলোনা। পবিত্র কুরআনের আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘‘ সত্য বিশ্বাসী  এক মুসলমানের পক্ষে সত্য বিশ্বাসী অপ মুসলমান ব্যাতিরেকে সত্য অবিশ্বাসী কোন অমুসলিমকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়’’। কুরআনের এই বানীকে লঙ্ঘনের মাধ্যমে আরবরা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ট্রাজেডি ফিলিস্তিন সংকটের সূচনা করেছিলো।
ঠিক সমবৈশিষ্ট্যের একটি ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞল নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট এবং আদিবাসী সংস্থাাগুলোর তৎপরতা থেকে এই অঞ্চলকে নিয়ে বিদেশী ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে Peace campaign group  এর প্রকাশিত একটি ইমেইল  বার্তা থেকে এই অঞ্চলে পুর্ব তিমুরের মত একটি খ্রীষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা প্রকাশ হয়। ইমেইল বার্তাটির বিশেষ করে শেষ অংশে এই ষড়যন্ত্র ফুটে উঠে । ইমেইল বার্তাটি হচ্ছে,
Peace Campaign Group, Fri Apr 25, 2008, Free Jummaland (CHT) in line with East Timor, Bappi Chakma,
 Over two and one half decades, the indigenous people of the Chittagong Hill Tracts, mostly Buddhists, Hindus and Christians by faith, fought with Bangladesh for autonomy and for protection of their distinct identity and culture threatened with extinction for the latters policy of so-called national integration, locally called Islamization policy.
The terrors unleashed by Bangladeshi military forced the indigenous people to accommodate with the state-policy of islamization without any protest. It is breeding new problems in the CHT which may drag Bangladesh into a vicious and long-standing cycle of violence and instability. One of such problems is, as developments suggest, regrouping of former guerrillas coupled with new and hot bloods completely dedicated to a new idea - Free CHT or Jummaland in line with East Timor)http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/47958?source=1&var=1


এই ষড়যন্ত্রের অংশ স্বরুপ পার্বত্য চট্রগ্রামে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রসার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১৪টি জাতিস্বত্তার মাঝে চাকমা, মারমা , রাখাাইন, তংচইঙ্গা,পাংখোয়া, লুসাই ও বোমাং উল্লেখযোগ্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাংখোয়া, লুসাই ও বোমাং উপজাতীয়দের মাঝে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ধর্মান্তরিত হচ্ছে। খাগড়াছড়ির পানছড়ি, লক্ষীছড়ি, মানিকছড়ি, বাঘাইছড়ি ও সাজেক এলাকায় গভীর পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষজনই আকৃষ্ট হচ্ছে ভিন্ন ধর্মে। অন্ন্ বস্ত্র, বাসস্থানসহ বিভিন্ন্ সুবিধা পাচ্ছে অবহেলিত এসব পাহাড়বাসী। মিশনারীগুলো তাদের সেই দূর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে। বলা হচ্ছে, খ্রিষ্ট্র ধর্ম গ্রহণকারীরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করছে। ১১
এই অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন আশ্রম গড়ে উঠেছে যেখানে বিভিন্ন উপজাতীয়দেও মাঝে যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে তাদের সন্তানরে লালন পালন ও পড়ালেখা করানো হয়।
এছাড়াও গত ২৭ জুলাই,২০০৭ এক ইমেইল বার্তায় মাইনরিটি কংগ্রেস পার্টির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন শচীন কর্মকার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এর কাছে পৃথক স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠনের ব্যপারে সহায়তা চেয়েছে। এই ইমেইল বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ মুসলিম মৌলবাদীদের সেফটিক ভালব। আজ তোমরা আমাদের সাহায্য করো কাল আমরা তোমাদের সাহায্য করব। এতে বলা হয়, সি আই এর সামনে বাংলাদেশে দুটি  পথ খোলা রয়েছে, এক. বাংলাদেশে বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের জন্য চাপ দেয়া। দ্্্্্্্্্্্্্্্্্ইু. কুর্দিস্তানের মত পূর্ব ভারত সীমান্ত ঘেঁষে সংখ্যালঘুদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা। যদি এই দলটি আমেরিকা এবং ইউরোপ থকে যথেষ্ট সহায়তা পায়, তাহলে তারা সহজেই তা বাস্তবায়ন করতে পারবে। ১২
এইসকল আসঙ্কাগুলো আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠে যখন সেখানে বিদেশী এনজিও গুলোর তৎপরতা ব্যপক হারে লক্ষ্য করা যায়। এই এনজিগুলোর বিরুদ্ধে খোদ উপজাতীয়দেও মাঝেই ক্ষোভ রয়েছে। কেননা, এনজিও গুলো উন্নয়নের চেয়ে বিভেদ ছড়াতেই বেশী ব্যস্ত।এতে করে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে । শুধু বিদেশী এনজিও ই নয় বাংলাদেশের মূলধারার এনজিও গুলোর বিরুদ্ধেও এধরনের অভিযোগ রয়েছে।
তাছাড়া United People's Democratic Front (UPDF)  পার্বত্য চট্রগামে স্বাধীন রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠার জন্য  দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। এই সংগঠনটি ভারত থেকে সহায়তা পায় বলে অনেকে মনে করেন। এই সংগঠনটি বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সহিত জড়িত। তবে সম্প্রতি পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই এর হুমকি দেন। বিশেষজ্ঞ মহল সন্তু লারমার এই হুমকির পেছনে বাহিরের সমর্থন থাকতে পারে বলে মনে করেন। একদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীকে জাতিয়তাবাদে উদ্ভুদ্ধ করে স্থানীয় জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করছে। অপর দিকে এই অঞ্চলে গোপনে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার করছে বিশ্বায়নের নামে।  গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার খর্ব করা নৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্রে স্যাটেলাইট স্টেট তৈরী করে আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করার যেকোন পদক্ষেপ কোন ক্রমেই সমর্থিত হতে পারেনা।

বিশ্বায়ন, জাতিয়তাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ
বিশ্বায়নের ধারনাটি ১৯৩০ সালের পর থেকে বিস্তারলাভ করলেও ¯œায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ‘সন্ত্রাসবাদ’ নামক ধারণার উদ্ভব ঘটায়। এর মাধ্যমে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে টার্গেট করা হয়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত স্বাীধনতাকামী মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলো (যারা ঐ দেশের সরকার কর্তৃক বৈষম্যের স্বীকার) সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে। যেমন স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের উপর ভারত সরকার অত্যাচার নির্যাতন করলেও পশ্চিমা শক্তিকে এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকায়ই দেখা যাচ্ছে। কারন, ভারতের সহিত তাদের আদর্শিক সাজুয্যতা রয়েছে। আফগানিস্তানে ১৯৭৮ সালে  সোভিয়েতপন্থী ‘কমিউনিস্ট পিপল’স ডেমোক্রেটিকস পাটি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ)’ ক্ষমতায় আসে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারকে সাধারন জনগণ গ্রহণ করেনি, বিশেষ করে ধর্মীয় মোল্লারা। কেননা, পিডিপিএ সরকারের উপর সোভিয়েত প্রভাব প্রবল ছিলো। কিন্তু দলীয় কোন্দলের একপর্যায়ে(খালক ও পারচামপন্থী)*রাশিয়া সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আফগানিস্তানে। ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত সমর্থন নিয়ে বাবরাক কারমাল মস্কো থেকে দেশে ফিরেন। সাথে সোভিয়েত সেনাবাহিনী। যার ফলে দু’শোরও বেশি উপজাতিয় গোষ্ঠী এবং আফগান সেনাবাহিনী ত্যাগকারী সৈন্যরা রুশ ও সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোতে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদী আরব পাকিস্তানের আই এস আই এর মাধ্যমে সাহায্য করতে থাকে। টাইমস অব ইন্ডিয়া ২০০১ সালের ৭ মার্চ এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে তাতে বলা হয় ১৯৮০ সালে সি আই এ আফগানিস্তানে ইসলামি গোষ্টীগুলোকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত দখলদারিত্ব বিলোপ হলে এই সাহায্য কমতে থাকে। গেরিলা যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল কাবুলের পতন হয়। এবং মুজাহিদীনরা ক্ষমতায় আসে। ইতিপূর্বে ¯œায়ূযুদ্ধের অবসান হয়। মার্কিন নের্তৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রধান প্রতিদ্বন্ধি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে বিশ্বরাজনীতি একমেরুকেন্দ্রীক হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী বিশ্ব নতুন শত্রু হিসেবে বেছে নেয় ইসলামকে। অবতারনা হতে থাকে নতুন নতুন তত্ত্বের।এসকল তত্ত্বেও মধ্যে অন্যতম সভ্যতার সংকট তত্ত্বটি। ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসার পরেও মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য অব্যাহত রাখে আফগানিস্তানে। কারন  ভূকৌশলগত দিক থেকে আফগানিস্তান সমগ্র এশিয়ার ট্রানজিট। এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারলে এশিয়ায় পশ্চিমা প্রভাব ধরে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু তালেবান সরকার ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। এদের হাতে চলে আসা মার্কিণ অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে দাড়ায়। ফলে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয় । ১১ সেপ্টেম্বর এর টুইন টাওয়ার এ হামলা মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার আলোকেই হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কেননা টুইন টাওয়ার হামলার ফলে বিপুল পরিমান ক্ষতি হলেও এটি ছিলো মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্ত্র ব্যবসার একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরীর মাধ্যম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যক্ষেত্রে অস্ত্রের ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠে। ১৯৩০ এর দশকে মার্কিন মুলুকে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে প্রথমে ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ তারপর ‘মার্শাল প্ল্যান’ এর মাধ্যমে ইউরোপ এবং এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো মার্কিণ প্রভাব বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সামরিক সহযোগীতার লক্ষ্যে ন্যাটো (১৯৪৯) গঠন করা হয়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরুপ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রভাবাধীন রাষ্ট্রগুলো নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারসপ্যাক্ট(১৯৫৫)। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই সংস্থাটি বিলুপ্ত হলেও বিলুপ্ত হয়নি ন্যাটো।  বিশ্বব্যাপী মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের বিস্তার এবং নতুন শত্রু ইসলামকে মোকাবেলা করার জন্যই ন্যাটোর টিকে থাকা। নব্বই এর দশকে প্রকাশিত স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন সভ্যতার সংকট তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র সেই তত্ত্ব বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ইসলামী সন্ত্রাসবাদ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটায়। এবং ইরাক, আফগানিস্তান লিবিয়া, সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া  সৌদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীসমূহের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে দায়ী করে আসছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। ২০১১ সালে সৌদী আরব বিশ্বে অস্ত্র আমদানীতে ২য় অবস্থানে ছিলো(প্রথম ভারত)। আর অস্ত্র রপ্তানীতে শীর্ষে রয়েছে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র।  অস্ত্র রপ্তানীর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মূল্যবান ‘পেট্রোডলার’ হাতিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়, এক. অনেক বিশেষজ্ঞের মতে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোর মাধ্যমে (যারা মার্কিনীদের মিত্র) পরোক্ষভাবে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। দুই. এর মাধ্যমে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অস্ত্রবাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখছে। তিন.মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যদি সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের সরবরাহ করে নাও থাকে , তাদেরকে সন্ত্রাসবাদের বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ধুয়া তুলে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করছে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মূল্যবান তেল সম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থ চলে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার ব্যাংকে। আর তা দিয়ে পশ্চিমা শক্তি তৃতীয় বিশ্বে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। বিশাল অঙ্কের এই পেট্রোডলার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে। চার. যে দেশই পশ্চিমাদের পাতানো এ ফাঁদে সাড়া দিতে অসম্মত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেই তোলা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ বা গণতন্ত্রায়নের নাম করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফীর এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।  
ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের একটি স্যাটেলাইট স্টেট। ইহুদী জাতিয়তাবাদী শক্তিকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ইসরাইলকে। অপরদিকে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে বিশ্বায়নবাদীরা। সর্বশেষ নভেম্বর ২০১২ গাজায় ইসরাইলী হামলার পর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অসদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভের প্রশ্নে না ভোট দেয় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। দক্ষিন আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় ছিলেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য  এবং মার্কিণ প্রভাবিত সরকারের বিরোধীতা করার জন্য।
বিশ্বায়ন , জাতিয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ
জাতিয়তাবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়ীকতাবাদের । সুপ্রাচীন কাল থেকে সাম্প্রদায়ীকতা ধর্ম এবং অর্থনীতির গন্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলো। সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম একটি মাধ্যম সামাজিক স্তরবিন্যাস। এর সাথে যুক্ত হয় ধর্ম, জাতি এবং রাজনৈতিক শক্তি। তবে সব সমাজেই ধর্ম এবং জনগণের প্রগাঢ় বিশ্বাস সাম্প্রদায়িকতা গঠন ও চর্চায় মূল কর্মকের ভূমিকা পালন করে আসছিলো। আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতা তার প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি। বিশেষ করে একুশ শতকের বিশ্বব্যবস্থায় পুরোনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কাঠামো দূর্বল হয়ে পড়ে । ধর্মভিত্তিক এই সাম্প্রদায়িকতা গড়ে উঠেছিলো সামন্তবাদেও জঠরে। আধুনিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক  ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব খর্ব করার  ফলে বিলোপ হতে থাকে  সামন্তবাদের। সামন্তবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থার ধ্বংশস্তুপ থেকে জন্ম নেয় নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। এই নতুন সাম্প্রদায়িকতায় সংস্কৃতি একটি বিশাল স্থান দখল করে আছে। বিশ্বব্যাপী জনগণের সাংস্কৃতিক জীবন এই সাম্প্রদায়িকতা গঠনের প্রধান নিয়ামক। রেঁনেসা পরবর্তী সময়ে ইউরোপের সমাজে সামন্তবাদের বিলোপ হতে থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও কিছুকাল যাবৎ এ ব্যবস্থাটি টিকেছিলো। তবে শোষকের বা ক্ষমতাসীনদের স্থানের পরিবর্তন হয়ে যায়। যেখানে দেশভাগের পূর্বে সমগ্র সমাজে হিন্দু সামন্তপ্রভূদের শোষণ ছিলো। সেখানে তথাকথিত ধর্মীয় জাতিয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশভাগের পর পাকিস্তানে মুসলিম এবং ভারতে হিন্দু সামন্তপ্রভূদের আবির্ভাব ঘটে।
১৯৪৭সাল থেকে বিশেষতঃ ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কাছাকাছি সময়ে, পূর্ব বাংলার ছাত্র ও শিক্ষিত যুব সমাজের একাংশের মধ্যে সামন্তবাদ বিরোধী চিন্তা-ভাবনাও ধ্যান-ধারনার সূত্রপাত হয় এবং তরুন লেখক ও শিল্পীদের একটি ছোট গোষ্ঠী তাদের রচনা ও শিল্পকার্যের মাধ্যমে এই সামন্ত-বিরোধীতাকে কিছুটা নির্দিষ্ট রুপদানের চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টাকালে তারা যে শুধু ধর্মীয় চিন্তার কাঠামোকেই ভাঙ্গার চেষ্টা করেন তাই নয়, অন্যান্য অনেক সামন্তবাদী চিন্তা , আচার-আচরন এবং অনেক কাঠামোকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেন।
কিন্তু পরবর্তীতে বৎসরগুলোতে দেখা গেলো যে, পঁঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে সামন্তবাদবিরোধী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শিল্প-সাহিত্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো বাস্তবতঃ তার কোন উপযুক্ত বিকাশ ঘটলো না।  উপরন্তু পঞ্চাশের দশকের প্রায় সব লেখক শিল্পী, সাহিত্যিকরাতো বটেই, এমনকি পরবর্তী পর্যায়ের নবীনতর লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকরাও বিপুল সংখ্যায় কোন না কোন প্রকারে বর্তমান শোসক শ্রেনীর সেবাদাসে পরিণত হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সা¤্রাজ্যবাদের অনুকূল সংস্কৃতি রক্ষা, নির্মান ও প্রচলনের উদ্দেশ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখলেন। এর ফলেই বর্তমান বাংলাদেশে আমরা সংস্কৃতি-চর্চার নামে, গবেষণার নামে, জনগণের সংস্কৃতির নামে যা দেখছি আসলে তা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের পায়রাবী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলাম বিদ্বেষ। যা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের নব্য উদ্ধাবন। সমগ্র বিশ্বব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা, উদারতারবাদের নামে অনৈতিকতা এবং মুক্তচিন্তার নামে অশ্লীলতার জয়গান উদ্ভব ঘটায় নতুন ধরনের সমাজ চেতনার। যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিকে জাতীয় চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন এই সমাজ চেতনা ব্যপকভাবে পাশ্চাত্যবাদী বুদ্ধিজীবিদের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি এবং রাজনৈতিক নেতারা জাতিয়তাবাদী চেতনার আড়ালে এবং অনেকটা নিজেদের অগোচরে বিশ্বায়নবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। ¯œায়ূযুদ্ধের পর এই প্রবনতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা, এসময়ে প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে মানুষের দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে। এবং এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই স্ব-স্ব জাতির জাতীয় সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে জাতিয়তাবাদী চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে থাকে। নতুন এই সমাজ এবং জাতীয় চেতনাই উগ্ররুপ ধারন করে সৃষ্টি করছে নতুন সাম্প্রদায়িকতার । যাকে ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই সাম্প্রদায়িকতার মূল উপাদান ধর্মবিদ্বেষ বা বলা যায় ইসলাম বিদ্বেষ। যেহেতু পৃথিবীতে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুলোর সুসামঞ্জস্য কোন কাঠামো বিদ্যমান নেই, যার ভিত্তিতে একটি মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবন পরিচালিত হতে পারে।
দেশের সমগ্র জনগণের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবি এবং রাজনৈতিকদের দ্বারা পরিচালিত এই সাম্প্রদায়িকতাই নতুন প্রজন্মের মানসিকতা গঠনে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করছে। উদাহরন হিসেবে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তিতে শর্তারোপ করার কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষাকে উপেক্ষা এবং নারী নীতিতে নারী অধিকারের মোড়কে ইসলাম বিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এই সাম্প্রদায়িকতার অভ্যন্তরীন কাঠামো তৈরী করা হচ্ছে। মিডিয়া এক্ষেত্রে ব্যপক ভূমিকা রেখে চলছে। পূর্ববর্তী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কাঠামোতে পাকিস্তান সরকার তাদের যেকোন নিপীড়নমূলক নীতিমালাকে ইসলামী সংস্কৃতি রক্ষার নামে বাংলাভাষী জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলো এবং এর প্রতিরোধকারীদেরকে ইসলাম-বিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করতে নিযুক্ত ছিলো। বর্তমান এই সা¤্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক বা ধর্মনিরপেক্ষ সামাপ্রদায়িক কাঠামোতে শাসকশ্রেণী বৈষম্যমূলক এবং নীপিড়নমূলক নীতিমালাসমূহ জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং এর বিরোধীতাকারীদের ধর্মীয় মৌলবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়ে দমনে নিযুক্ত।  ।          

এক্ষেত্রে বদরুদ্দিন ওমর এর বক্তব্য প্রনীধানযোগ্য। তার ভাষায়,
  ‘‘১৯৪৭ সালের পূর্বে শোষক শ্রেণীর মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য এবং শোষিত শ্রেণীর মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের ফলে তৎকালীন সমাজভূমিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র যতটা উর্বর ছিলো বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে উর্বরতা অনেক কমে গেছে। এ জন্যেই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কোন রাজনৈতিক দল আজ আর এদেশে ধর্মের জিগীর তুলে পূর্বের মত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবেনা। কিন্তু সেটা না পারলেও সাম্প্রদায়িক চিন্তা সাধারণভাবে এদেশে যে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে তা নয়। উপরন্তু সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের রাজনীতিকে এখন পূর্বের তুলনায় অনেক সূক্ষ্মতরভাবে অগণতান্ত্রিক পথে চালনা করতে সক্ষম হচ্ছে।   সাম্প্রদায়িকতার এই শক্তি ও সামর্থ্যের ব্যাখ্যা বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবনে যতখানি পাওয়া যাবে তার থেকে অনেক বেশী পাওয়া যাবে জনগণের সাংস্কৃতিক জীবনে।’’ ১৩
নতুন এই সাংস্কৃতিক বা ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতা শুধু জনগণের সাংস্কৃতিক জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, সর্বোপরি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে চলছে প্রতিনিয়ত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে র্পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিস্তার, সামাজিক ক্ষেত্রে স্বার্থপরতা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সা¤্রাজ্যবাদের অনুসরন এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে আধুনিকতা এবং উদারতার নামে বিকৃতকরন নব্য সাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্য।
এই ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আবেগাপ্লুত মনোভাবের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধরত বাম রাজনীতিকরা কাজ করে যাচ্ছে। বলা যায় বাংলাদেশে বাম দলগুলো বিশ্বায়নবাদীদের এই নব্য ষড়যন্ত্রের শিকার। শুরু থেকেই ইসলাম বিদ্বেষী হতে গিয়ে তারা সাম্প্রদায়িতাকে নিজেদের মত করে সংগায়িত করে নিয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সমাজ জীবনে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব কখনোই ছিলোনা। এখানে হিন্দু মুসলিম একই উঠানে বসবাস করতে অভ্যস্ত। বিশ্বরাজনীতি এবং দেশীয় রাজনীতিকদের স্বার্থেই এখানে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলা হয়। ভারতের মত বাংলাদেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। সাধারণ জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব না থাকার ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িক এই কাঠামো শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের প্রচারক দেশগুলোর মাঝেও প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের উদারবাদী এবং বহুসংস্কৃতির ধারক বলে দাবী করলেও এবং নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার স্বার্থে তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর মাঝে সুকৌশলে এর বিস্তার ঘটালেও নিজেরাই এই নব্য সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এমনকি মুসলমানদের মাঝে যারা একমাত্র নামটি বাদে আর কোন ইসলামী আচরন ধরে রাখতে পছন্দ করেন না তারাও স্বীকার হচ্ছেন এই সাম্প্রদায়িক অনাচারের। বলিউডের সুপারস্টার শাহরুখ খানের মত নামী দামী এবং পশ্চিমা ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিকেও মার্কিণ বিমান বন্দরে ঘন্টার পর ঘন্টা জবাবদিহি করতে হয়েছে শুধুমাত্র নামের শেষে ‘খান’ থাকার কারনে।

বিশ্বায়ন,জাতিয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাঃ ইসলামী দৃষ্টিকোন 
বিশ্বায়ন সর্বোতভাবে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি হলেও ইসলাম একে অস্বীকার করেনা। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়ন সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে মুসলিম বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহর উপর। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ নিজেদের মূল দায়িত্ব ভুলে যাওয়াতে বিশ্বায়নের পাশাপাশি  ক্ষুদ্র জাতিয়তাবাদী চেতনাও (যা বিশ্বায়ন দ্বারা আক্রান্ত) মুসলিম উম্মাহর ধারনাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। পাশাপাশি সা¤্রাজ্যবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ষড়ন্ত্রের শিকার ইসলামী চিন্তাধারা। ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবিরা ইসলামী যে কোন কার্যক্রমকেই মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে সিদ্ধহস্ত। অথচ ইসলামে সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনার কোন স্থান নেই। ইসলাম এসেছে মানব জাতির মুক্তির জন্য। একটি সার্বজনীন সুখী সমৃদ্ধ পৃথিবী পরিচালনার লক্ষ্যে মহান প্রভূ নাজিল করেছেন সুসামঞ্জস্য নীতিমালা (কোরআন ও অন্যান্য আসমানী গ্রন্থ)। অবশ্য সর্ব যুগেই সর্বকালেই কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে এই নীতিমালার অপব্যবহার করেছে। মানবরচিত মতবাদকে ঐশীবাণীর মোড়কে উপস্থাপনকারী এসকল লোকেরাই পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে চলছে।
ইসলামের যে বিশ্বায়নধর্মী একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা ফুটে উঠেছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম তাত্ত্বিক আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারায়। তার মতে, প্যান ইসলামবাদ হলো বিশ্ব মানবতাবাদ। ইসলামের বাণী হলো বিশ্বজনীন এবং এটা সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রণীত হয়েছে। তাঁর মতে ইসলামের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দুটি মৌলিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিতঃ ক) তাওহীদ বা খোদার একত্বতা এবং খ) মানুষ হলো পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি এবং জিম্মাদার। ইসলাম মানুষকে সকল সংকীর্ণতার উর্দ্ধে তুলে দেয় এবং বিশ্ববাসীদের নিয়ে একটা সংঘবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলে। তাঁর ভাষায়-
ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো এটা সকল প্রকার ভৌগলিক সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে । এবং এর উদ্দেশ্য হলো বিশ্বমানবতাকে একটা চূড়ান্ত এককে পরিণত করার একটা রুপরেখা উপহার দেয়া। এটা পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বর্ণ-গোত্র থেকে এর অনুসারী তৈরী এবং এটিকে সামষ্টিক একটা জনসমষ্টিতে রুপান্তর করে, যে জনসমষ্টি তাদের স্ব-স্ব আত্ম চেতনা বহন করে। ১৪
 মুসলিম বিশ্বের অপর একজন তাত্ত্বিক হলেন ইমাম খোমেনি। যিনি স্বদেশ প্রেম ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।  তিনি স্বদেশপ্রেমকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বলে গণ্য করেন। কিন্তু, জাতীয়তাবাদকে বর্জন করেছেন দুটো কারনে, ক) এটা ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীত এবং খ) এটা একটা বিজাতীয় ধারণা। যেটা মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার জন্য বিদেশীরা প্রচার করছে। তিনি বলেন-
একজনের পিতৃভূমি এবং জনগণকে ভালবাসা এবং সীমানার নিরাপত্তা সংরক্ষণ করা উভয়ই অনাপত্তিকর, কিন্তু জাতীয়তাবাদ যেটা অন্য মুসলিম জাতির প্রতি বৈরিতার সঙ্গে জড়িত সেটা সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন বিষয়। এটা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এবং রাসূলের(সঃ) আদেশের পরিপন্থী। জাতীয়তাবাদ যেটা মুসলিমদের মধ্যে শত্রুতা  সৃষ্টি করে এবং মুসলিম বিশ্বাসীদের মর্যাদায় ফাটল ধরায় সেটা ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থের পরিপন্থী। জাতীয়তাবাদ হলো বিদেশীদের দ্বারা গৃহীত একটা কৌশল যারা ইসলামের প্রসারকে সহ্য করতে পারেনা।  ১৫

ইসলাম যদিও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির কথা বলে, কিন্তু এখানে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কোন স্থান নেই। রাসূল (সাঃ) কর্তৃক পরিচালিত মদিনার সমাজে খ্রীষ্টান, ইহুদী, পৌত্তলিকসহ আরো অনেকে বাস করত। ইসলাম একটি আন্তর্জাতিক ধর্ম হওয়ার ফলেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে মদিনার সেই ইসলামী সমাজ গড়ে উঠেছিলো। এক্ষেত্রে সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদীর(১৯০৩-১৯৭৯) চিন্তাধারা উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলাম হলো আন্তর্জাতিক এবং এর বাণী হলো  বিশ্বজনীন।
এটা সমগ্র মানবজাতির প্রতি বিশ্বাস ও নৈতিকতাভিত্তিক একটা সুবিচারমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপস্থাপন করে এবং সকলকে এর প্রতি আহ্বান করে।.... ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটা বিশ্ব-রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে বর্ণ ও জাতিয় গোড়ামী ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে এবং সকলের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ সুবিধা সমন্বিত একটা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেটা সমগ্র মানবজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করবে। এবং যেখানে মানুষের মধ্যে তৈরী প্রতিযোগিতার পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগীতার জন্ম দেবে যাতে তারা তাদের বস্তুগত ও নৈতিক উন্নতির জন্য একে অপরকে সহায়তা করবে।১৬

বিশ্বায়ন, সা¤্রাজ্যবাদ এবং উগ্র জাতিয়তাবাদের ফলে যেমনি মানুষের অধিকার ভূলুন্ঠিত হয় তেমনি ব্যহত হয় সামাজিক সুবিচার। এই তিনটি প্রপঞ্চেই ক্ষমতার চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রাখার জন্য এর উদ্ভাবকরা সদা সচেষ্ট থাকে। ফলে, শক্তিশালী আর অসহায়ের মাঝে একধরনের মাঝে দ্বান্ধিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। যা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সর্বত্র বিরাজিত। অথচ ইসলাম সামাজিক সুবিচারের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সকল ব্যবধানকে দূও করার তত্ত্ব দেয়। মিশরীয় ইসলামী চিন্তাবীদ শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব এর মতে,
ইসলামী সামাজিক সুবিচার  হলো একটা ব্যপকভিত্তিক মানবিক সুবিচার। এটা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সুবিচার নয়, এতে জীবনের সার্বিক দিক ও সব ধরনের মুক্তি অন্তর্ভূক্ত।  এটা মানুষের দেহ, মন, আত্মা ও চেতনা সব ব্যাপারেই সতর্ক। এই সুবিচার শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মূল্যবোধ অথবা বস্তুগত মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়না; এটা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে একত্রে গণ্য করে। ১৭
মূল্যায়নঃ
সার্বিকভাবে বিশ্বায়ন ও জাতিয়তাবাদের ধারণা বিশ্বসভ্যতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। কোথাও তা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে আবার কোথাও মৌধিক অধিকারকে রক্ষা করছে। তবে এই রক্ষা এবং হরণের মাঝে সবসময়ই নিজ স্বার্থ জড়িত ছিল। এটি সবসময়ই স্থানিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে আচরণ করেছে। একই বিষয় কারো কাছে অবিচার বলে বিবেচিত হলেও হয়ত অত্যাচারীর কাছে তা বৈধ আচরন ছিল। পশ্চিমা বিশ্বায়নবাদীরা বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অবিচার আর ন্যায়বিচারের ধারণাকে নিজেদের মত করে তৈরী করেছে সময়ের প্রয়োজনে। কখনো তারা জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছে বিরুদ্ধবাদীদের দমনের উদ্দেশ্যে। আবার কখনো জাতীয়তাবাদকে দমন করেছে বিশ্বায়নের নামে। ইসলামকে সাম্প্রদায়িক ধর্ম আখ্যা দিয়ে ধর্মরিপেক্ষতার নামে নিজেরাই তৈরী করে চলছে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা। পাশ্চাত্য বিশ্বের তৈরী এই ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতা সমগ্র বিশ্বের সমাজ জীবনে অস্থিরতা সৃস্টি করে চলছে। ভোগবাদী চিন্তাধারার মানুষ আজ নিজের স্বার্থে পৃথিবী ধ্বংশ করে ফেলতের দ্বিধা করেনা। মুক্ত চিন্তার অন্তরালে সত্য বিদূরিত হচ্ছে হাওয়ার বেগে। তবুও সত্য সন্ধানী একদল মানুষের জন্যই পৃথিবী এত সুন্দর। তারা আর বিশ্বায়নবাদীদের ফাকাবুলীতে বিশ্বাস করেনা। আবার উগ্র-জাতীয়তাবাদের নগ্নরুপ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) দেখে এর উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ এখন এমন একটি বিশ্বব্যবস্থার দিকে পঙ্গপালের ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের স্বতন্ত্রতা নিয়েও অন্যের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারবে। পারস্পরিক সম্পর্কের মূলভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, স্বার্থ নয়। আর সেই বিশ্বব্যাবস্থার নিশ্চয়তা দেয় ইসলাম। কিন্তু, মুসলিম উম্মাহর মানসিক ও নৈতিকতার জগৎ আজ ইসলামী মূল্যবোধ থেকে যোজন যোজন দূরে। মুসলিম মানসের এই সংকট কাটিয়ে উঠে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা তৈরীর জন্য কাজ করা সময়ের দাবী।


তথ্যসূত্রঃ
১.    .      k. w. deutsch, Nationalism and Social Communication, (Cambridge: MIT Press, 1953)
2.Ernest Gellner, Nations and Nationalism, (Ithaca: Cornell University Press, 1983)
     3.   Ernest Gellner, 1983, p-112
৪.     মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, বিশ্বায়ন: ইসলামী দৃষ্টিকোণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, জুলাই- সেপ্টেম্বর ২০০৫
৫.     পল এম সুহাজি, বিশ্বায়ন (প্রবন্ধ), বিশ্বায়ন ভাবনা দুর্ভাবনা থেকে।
৬.     ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশ্বায়ন নাকি আন্তর্জাতিকতা (প্রবন্ধ), দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৩ সেপ্টেম্বর’০৪।

৭.    M. Confirius, Angst Vordem nuen Denken? (নব্য চিন্তাধারার আতঙ্ক ) In; Rote Blaettr (দর্শন পত্রিকা) No 10/88, Frankfrut. p.13
৮.      তবুও কমউনজিমরে কথাই বলতে হব,ে ফরহাদ মাজহার, দনৈকি আমারদশে-২৬ডসিম্বের,২০১২
৯.     ইয়াসির নাদিম, বিশ্বায়নঃ সা¤্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্রাটেজি,প্রফেসর’স পাবলিকেশনস, পৃষ্ঠা-৬৯
১০.   http://groups.yahoo.com/group/mukto-mona/message/47958?source=1&var=1
১১.  সমকাল, ১০র্মাচ২০০৮
১২. আমারদশে, ১২নভম্বের২০০৭
১৩.   (বদরুদ্দিন উমরঃ বাংলাদেশে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সমস্যা, জাতিয় গ্রন্থ প্রকাশন। পৃষ্ঠা-১৪)
১৪. . Muhammad Iqbal, The Reconstruction of Religious Thought in Islam,(Lahore: S.M. Ashraf), p-169
১৫. . Imam Khomeini, Islam and Revolution, tr. Hamid Algar,(Berkeley: Mizan Press, 1991) p-49
১৬.Qutb, Sayyid, Social Justice in Islam, Cairn:n.d.
১৭. . Nationalism in the Twentieth Century, NEW YORK: New York University Press, 1979         

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন